হাওরে রহস্যে ঘেরা ‘দিল্লির আখড়া’
প্রকাশিতঃ 3:46 pm | August 02, 2021

জেলা সংবাদদাতা, কালের আলো:
বর্ষাকালে পানির রাজ্য হাওরে ক্ষণে ক্ষণে দেখা মিলে হিজল গাছের। কখনও বা সারি সারি, মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে দুই একটি অন্যান্য দেশীয় বনসাই।
এর মাঝে এক উচু জায়গায় অবস্থান বিশাল এক আখড়ার। আখড়ার দুই দিকে পুকুর। ভেতরে সাধকদের সমাধি। রয়েছে ধর্মশালা, নাটমন্দির, অতিথিশালা, পাকশালা ও বৈষ্ণবদের থাকার ঘর। পাঠকক বলছি ‘দিল্লির আখড়া’র কথা।
কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা মিঠামইনের শেষ প্রান্ত কাটখালে ৩৭২ একর জমিতে এ আখড়ার অবস্থান। নাম দিল্লির আখড়া হলেও এটি ভারতের দিল্লির কোনো অংশ নয়, তবে যোগসূত্র রয়েছে।
লোকমুখে জানা যায়, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় সাধক নারায়ণ গোস্বামী এই আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বেড়াতে এসেছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর।
আখড়ার সেবায়েত বৈষ্ণবদের মতে, এর বয়স প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর। দিল্লির আখড়া ও এর হিজলগাছগুলোকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে গা ছমছম করা মিথ।
জানা যায়, একসময় এলাকাটি জঙ্গল ছিল। চারদিকে নদী থাকায় মনে হতো দ্বীপ। তবে এ নদীপথে নৌকা চলাচল করতে পারত না। স্থানীয়দের ভাষ্য, রহস্যজনক কারণে নৌকা ডুবে যেত। একদিন এ নদীপথে দিল্লির সম্রাট প্রেরিত একটি কোষা নৌকা মালামালসহ ডুবে যায়।
বিতলঙ্গের সাধক রামকৃষ্ণ এ খবর পেয়ে শিষ্য নারায়ণ গোস্বামীকে এখানে আসার নির্দেশ দেন। সাধক নারায়ণ গোস্বামী এখানে এসে নদীর তীরে বসে শুরু করেন তপস্যা। হঠাৎ অলৌকিক ক্ষমতাবলে কে যেন তাঁকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। পরে তিনি তীরে উঠে আসেন।

প্রচলিত রয়েছে, টানা সাত দিন ধরে একই ঘটনা ঘটে। এক দিন দৈববাণী আসে, ‘আপনি এখানে থাকতে পারবেন না। চলে যান।’ উত্তরে সাধক বলেন, ‘তোমরা কারা?’ উত্তর আসে, ‘আমরা এখানকার বাসিন্দা। পূর্বপুরুষ ধরে এখানে আছি। আপনার কারণে আমাদের সমস্যা হচ্ছে।’
প্রত্যুত্তরে সাধক বলেন, ‘তোমরা স্পষ্ট হও, রূপ ধারণ করো।’ সঙ্গে সঙ্গে তারা একেকটা বিকট দানবমূর্তি ধারণ করে।
নারায়ণ গোস্বামী দেখলেন তাঁর চারপাশে হাজার হাজার বিশালাকার দানবমূর্তি। তাদের সঙ্গে তাঁর অনেক কথাবার্তা হয়। সিদ্ধান্ত হয় তিনিও থাকবেন। তবে তারা কারও ক্ষতি করতে পারবে না, নারায়ণ গোস্বামীর নির্দেশ পালন করবে। সাধক তাদের আদেশ করেন, ‘তোমরা আমার চতুর্দিকে সবাই হিজলগাছের রূপ ধারণ করো।’
তখন দানবদের প্রধান সাধুকে অনুরোধ জানিয়ে বলে, ‘সে যে হিজলগাছের মূর্তি ধারণ করবে, সেই গাছের নিচে বসে যেন তিনি তপস্যা করেন।’
অনুরোধ মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি দানব একেকটি হিজলগাছের মূর্তি ধারণ করে। সেই থেকে নারায়ণ গোস্বামী প্রধান দানবের হিজলরূপী গাছের নিচে বসে সাধনা করতেন। ফলে এর নাম দেওয়া হয় ‘সাধনবৃক্ষ’।
দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে এ খবর পৌঁছানোর পর তিনি এখানে এসে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর নামে বিশাল এলাকা লাখেরাজ দিয়ে একটি আখড়া প্রতিষ্ঠা করে দেন। সেই থেকে আখড়াটি ‘দিল্লির আখড়া’ নামে পরিচিত।

জেলা তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, সম্রাট জাহাঙ্গীর ১২১২ সালে আখড়ার নামে একটি তামার পাত্রে আখড়ার জমি লিখে দেন। কিন্তু ১৩৭০ সালে ডাকাতরা এই পাত্রটি নিয়ে যায় বলে আখড়ার সেবায়তরা জানান।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, প্রতিবছরই এই আখড়ায় পর্যটকদের সমাগম ঘটে। দিল্লির আখড়ায় প্রতি বছর ৮ চৈত্র দুই দিনের মেলা বসে। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে আখড়ায় আসতে হয়। বর্ষাকালে নৌকার কারণে যাতায়াত খুব সহজ।
সাংবাদিক টিটু দাস কালের আলোকে জানান, সারাবছরই মানুষ আসে। মেলা স্থানীয়দের কাছে যেন উৎসবে রূপ নেয়। সাধারণ পর্যটকের পাশাপাশি ইতিহাস সন্ধানী সচেতন পাঠকও আসেন।
আখড়ায় যাওয়ার বিষয়ে অষ্টগ্রামের এই বাসিন্দা বলেন, কিশোরগঞ্জ থেকে বাস বা সিএনজি করে চামড়া ঘাট; চামড়া ঘাট থেকে ট্রলার দিয়ে যেতে হয় দিল্লির আখড়ায়। বর্ষাকালে যাতায়াত বেশ সহজ।
কালের আলো/এমএ/বিএস