অভিন্ন রূপরেখা চূড়ান্ত হচ্ছে

প্রকাশিতঃ 10:21 am | October 10, 2018

ডেস্ক রিপোর্ট, কালের আলো:

ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অভিন্ন রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত। বিএপি, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আলাদা প্রস্তাব থেকে এটি তৈরি হচ্ছে। ১১ অক্টোবরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়ার সম্ভাবনা আছে। ছক অনুযায়ী তিন পক্ষ জোট করে ভোট করবে। এই ভোটযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিকরা থাকবে। সরকার গঠন করা সম্ভব হলে ক্ষমতার ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর আগে আসন সমঝোতার বিষয়টি ফয়সালা করবেন শীর্ষ নেতারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সংখ্যা কোনো বাধা হবে না। যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা যে যে আসনে নিশ্চিত জয় পাবেন, বিএনপি সেগুলো ছেড়ে দেবে। চাইলে এ দুই জোটের প্রার্থীরা ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়েও নির্বাচন করতে পারবেন। অথবা যার যার দলীয় প্রতীক নিয়েও নির্বাচন করতে পারবেন। দু’পক্ষের দাবি অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামকে জোটের বাইরে রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।

যুক্তফ্রন্ট এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রস্তাবে ন্যায়পাল নিয়োগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিটি ইউনিটে ন্যায়পাল নিয়োগ করা, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা গ্রেফতারে সরকারের অনুমতির বিধান (সরকারি চাকরি আইন-২০১৮) বাতিল করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, মন্ত্রিসভাসহ প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না, প্রধানমন্ত্রী দলীয় পদে থাকবেন না, ডেপুটি স্পিকার পদ সরকারি দলের বাইরে অন্যান্য দল থেকে দেয়া, উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ সৃষ্টি করে সরকারি দলের বাইরে অন্যান্য দলের মধ্যে থেকে নেয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, পুরোপুরি বন্ধ করার কথা উল্লেখ করা হয়। পুলিশি রিমান্ডে সব ধরনের শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের বেঁধে দেয়া গাইডলাইন শক্তভাবে অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সমালোচিত ধারাসমূহ (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩, ৫৩) ক্ষেত্রভেদে বাতিল বা সংশোধন করা, তথ্য অধিকার আইনে তথ্যপ্রাপ্তি দ্রুততর করার লক্ষ্যে সরকারি বাধা পুরোপুরি দূর করাসহ আরও বেশকিছু প্রস্তাব রয়েছে এতে।

এ ছাড়া বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ পৃথকীকরণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদের উচ্চকক্ষ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শক্তিশালী করা, কমিটির অর্ধেক সরকারি দলের বাইরে অন্যান্য দল থেকে নেয়া, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন স্বরাষ্ট্র, তথ্য, পররাষ্ট্র, অর্থ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অন্যান্য দলের অধীনে দেয়া, সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য সুস্পষ্ট আইন তৈরি করা, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিসহ সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য স্বাধীন কমিশন (বিরোধী দলীয় প্রতিনিধিসহ) গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রধান শরিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পক্ষ থেকে আসন ভাগাভাগির একটি প্রস্তব দেয়া হয়েছে। এতে বিএনপিকে ১৫০ আসন এবং যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য জোটকে ১০০ আসন দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া জামায়াতকে বাদ দিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ৪০টি আসন এবং সুধী সমাজের মধ্য থেকে ১০ জনকে মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১১ অক্টোবরের আগেই এগুলো চূড়ান্ত করে অভিন্ন রূপরেখায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাতে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় তারা ফের বৈঠকে বসবেন। সেখানে এসব ইস্যুতে সমঝোতা হবে। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়গুলো গণমাধ্যমকে অবহিত করা হবে। পাশাপাশি দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করা হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মঙ্গলবার বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন করছি। সরকারবিরোধী শিবিরে থাকা সব দলকে এক ছাতার নিচে এনে এ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে চাই। এ জন্য বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নিয়েছি। একটি জাতীয় ঐক্য গড়তে চাইলে বড় দল হিসেবে বিএনপিকেও কিছু ছাড় দিতে হবে। শরিকদেরও ছাড় দিতে হবে। এর মধ্য দিয়েই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পৌঁছুতে হবে।

সূত্র জানায়, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। এ দাবিতে তারা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এতে অনেকে সাড়াও দেয়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় জামায়াত ইস্যু ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা। যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে পরিষ্কার ভাষায় বিএনপিকে জানিয়ে দেয়া হয় যে তারা স্বাধীনতাবিরোধী কারও সঙ্গে জোট করবে না। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে ক্ষমতার ভারসাম্যও চান তারা। এ অবস্থায় দুই জোটের নেতাদের বিএনপির পক্ষ থেকে আশ্বস্থ করা হয়- তারা জামায়াতকে বাইরে রেখেই পথ চলবে।

দলটিকে বাইরে রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবে। এ ছাড়া নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জামায়াতকে বাইরে রেখেই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে সবাই একমত। এটি আশার খবর। এখন প্রয়োজন জনমত গড়ে তোলা। ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা। তিনি বলেন, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াসহ অনেকেই জামায়াত ইস্যুতে আপত্তি জনিয়েছে।

বিএনপির ভেতরের একটি অংশও দলটিকে চায় না। ২০ দলীয় জোটের অনেক শরিক এদের অপছন্দ করে। বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও এটা চায় না। দল হিসেবেও জামায়াতের নিবন্ধন নেই। তারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনও করতে পারবে না। এ অবস্থায় তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য এগিয়ে যাবে।

সূত্র জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায় টানা দু’দিনের বৈঠকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনের রূপরেখা প্রস্তুত করেছে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এখন চলছে সংসদীয় আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা। কয়েক দিনের মধ্যে এ বিষয়টিও ফয়সালা হয়ে যাবে বলে জানা গেছে। যেসব আসনে যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্যের প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে ছাড় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, রোববার ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের গুলশানের বাসায় আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার পরিচালনার রূপরেখার খসড়া তৈরি করে তিন পক্ষ।

পরের দিন সোমবার আ স ম আবদুর রবের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এটি চূড়ান্ত হয়। আ স ম আবদুর রবের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান এজেন্ডা ছিল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি। ওই বৈঠকে দুই জোটের নেতারা পরিষ্কার করে বলেছেন, শুধু আন্দোলন করে সরকার পতন তাদের লক্ষ্য না। আগামী নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেয়াটাও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। সুতরাং আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনই ফয়সালা করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের পতনের লক্ষ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। সে কাজে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি। আমরা এক সঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করেছি। নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের নেতাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আরও আলোচনা হবে। দেখা যাক কী হয়।’

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আসন ভাগাভাগির বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবেই আসছে। আশা করছি, খুব দ্রুত এ বিষয়টিরও ফয়সালা হয়ে যাবে।’ জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অতীত এবং বর্তমান অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখছি, ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা না গেলে ক্ষমতাসীন দল স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তাই এ বিষয়টি খুবই জরুরি।’

কালের আলো/এনপি