অনির্বাণ শোকগাঁথায় বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের মহাজীবন, উদ্দীপ্ত দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনী

প্রকাশিতঃ 11:53 pm | August 26, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। যেন প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। এমনই এক সময়ে অশ্রুভেজা মাসটিতে জাতির পিতাকে হারানোর বেদনায় মুহ্যমান হয়েই মহানায়কের ৫৫ বছরের মহাজীবনের নানা দিক নিয়ে পরিপ্লুত উচ্চারণ। কন্ঠে কন্ঠে ভয়াল আর ভয়ঙ্কর সেই রাতের ঘাতকদের নিষ্ঠুরতার কথা। হৃদয়ের ভেতরকার মর্মছেঁড়া কষ্টের প্লাবন।

বাংলায় নদীর স্রোতের মতো চির বহমান সেই অনির্বাণ শোকগাঁথায় নিজেকে মেলে ধরলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন ও আইজিপি ড.বেনজীর আহমেদ।

জনকের নৃশংসতম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও এই শোক থেকেই জাগরণের শপথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার দৃপ্ত অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত করলেন দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে। মুজিবাদর্শে শাণিত হয়েই জাতির চেতনায় চিরঞ্জীব আরাধ্য পুরুষকে আবেগমথিত উচ্চারণে স্মরণ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন।

বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর রমনায় পুলিশ কনভেনশন হলে জাতীয় শোক দিবস ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানেই গভীর মর্মস্পর্শী শোকের মাসে ইতিহাসের মহানায়ককে শোক-শ্রদ্ধার পাশাপাশি তাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বকেও ইতিহাসের আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বলভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান। দেশের সকল পুলিশ ইউনিট থেকে অন্যান্য কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন ভার্চুয়ালি।

জেলে বসে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘আমরা যখন বলি, বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনেকে এর বিরোধিতা করেন। আজকে আমাদের কাছে যে রেকর্ড পত্র রয়েছে, আমাদের প্রিজনে যে রেকর্ড পত্র রয়েছে, এসবিতে যে রেকর্ড পত্র রয়েছে তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে তিনি জেলে বসে নির্দেশনা দিতেন, চিঠি লিখতেন, কিভাবে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। এই ৫৫ বছরে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি জেলে গিয়েছিলেন।’

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পর ৫৪, ৬৬ ও ৬৯ এর আন্দোলনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে জনগণের কাছ থেকে স্বাধীনতার ম্যান্ডেট আদায় করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন সবখানে ছিল নাই, নাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর দক্ষতা দিয়ে, সৎ সাহস দিয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছেন। এজন্যই ঘাতকরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেনি। ঘাতকরা জানতো বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে সেই ঘুরে দাঁড়াবে। তাদের আশঙ্কা যথার্থই হয়েছিল।’

তিনি বলেন, তাঁরই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন একে একে তিনি বাস্তবায়ন করছেন। বাংলাদেশকে বদলে দেবেন। আজ তিনি বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। আজ আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

মন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জনগণের পুলিশ গড়তে চেয়েছিলেন। আজ আমাদের পুলিশ সেই জায়গাটিতে গিয়েছে। তারা আজ যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। জঙ্গি, সন্ত্রাস দমন থেকে আরম্ভ করে সবকিছু তারা সমানতালে করে যাচ্ছে বলে আমরা দেশকে শান্তির দেশে পরিণত করতে পেরেছি। আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু একজন সার্বভৌম বাঙালি, সার্বভৌম নেতা
মুখ্য আলোচক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, বিশ্বমিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনৈতিক কবি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর কাউকে দেওয়া হয়েছে কি না আমি পাইনি। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম বাঙালির ইতিহাসে সার্বভৌম ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যখন বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন আপনারা লক্ষ্য করবেন, সেদিন প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কাজ করেছে, ঠিক সেভাবেই সকল কাজ চলেছে।

তার অর্থ দাঁড়াাচ্ছে তিনি প্রথম এমন একজন মানুষ যিনি একজন সার্বভৌম বাঙালি, সার্বভৌম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যার কথা অক্ষরে অক্ষরে জাতি পালন করেছে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির ক্ষেত্রেই নয়, বঙ্গবন্ধু এই উপমহাদেশে সেই সাথে বিশ্ব মানচিত্রে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছেন।

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু র‌্যাডিক্যাল’ ছিলেন না। কারণ বঙ্গবন্ধু সারা জীবন ধরে যে রাজনীতি করেছেন তা ছিল মানুষের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রাজনীতি, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে উদারনৈতিক রাজনীতি। তিনি মানবতাবাদ ও উদার নৈতিকতাবাদ লালন করতেন।

ড.নাসের চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশেও ষড়যন্ত্র হয়েছে। এজন্য কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। কারা কারা ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের মুখোশ একদিন উন্মোচিত হবে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সাজানোর চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু
সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশকে ভালবাসতেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।’

তিনি বলেন, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ রাখা হয়েছে, যা একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এ কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।

১৫ আগস্ট প্রতিটি স্বাধীন আত্মমর্যাদাবান বাঙালির জন্য চরম লজ্জার
নিজের বক্তব্যের শুরুতেই পুলিশপ্রধান ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার) অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর বক্তব্যের সূত্র ধরে বলেন, ‘যদি আমরা এই বঙ্গোপসাগরের সমস্ত পানি দিয়ে আমাদের হাত প্রক্ষালন করি, তারপরেও এই কলঙ্ক আমাদের হাত থেকে মুছবে না।’

বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের কালো রাতে নিহত শহীদদের আত্নার মাগফেরাত কামনা করে আইজিপি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশ সদস্যরাই রাজারবাগে মুক্তিযুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। ১৫ আগস্ট অবশ্যই প্রতিটি স্বাধীন আত্মমর্যাদাবান বাঙালির জন্য চরম লজ্জা এবং বেদনার।’

আইজিপি তার বক্তব্যে বলেন, চার হাজার বছরে বাঙালির নিজেদের স্বাধীন করার কোনো ইতিহাস নেই। চার হাজার বছর ধরে বাঙালি ছিল নির্যাতিত, বঞ্চিত। ক্ষুধা, জরা দারিদ্র ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। বঙ্গবন্ধু যখন বলেন, ‘আজ আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’ আসলে তিনি আমাদের চার হাজার বছরের দুঃখের কথা বলেন।

ব্রিটিশ জনপ্রিয় গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের একটি নিউজের হেডলাইন উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, ‘যখন বঙ্গবন্ধু হেঁটে বিমান থেকে নেমে আসেন তখনই বাংলাদেশ রিয়েল্যাটি। তার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ রিয়াল্যাটি ছিলো না।’

জাতি হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান তার কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি আজকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করছেন’ যোগ করেন আইজিপি।

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমার কাছে মনে হয় ঈশ্বর প্রেরিত। তা না হলে আই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমাদের জাতি সত্তার বিকাশ ঘটিয়ে অশিক্ষিত, দারিদ্র্য, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তিনি যেভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন এটি একটি অলৌকিক মহোময় কর্মকান্ড হিসেবে প্রতিপাদ্য হয়। কারণ একটা স্বাধীনতার জন্যে সুদৃঢ় সংস্কৃতির প্রয়োজন আছে। সেই সংস্কৃতি কখনো অল্প সময়ে বিকাশ লাভ করে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সম্ভবত ঈশ্বর প্রেরিত ছিলেন- যে কারণে এই মাত্র ২৪ বছরে মধ্যেই তিনি এটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’

সমালোচকগোষ্ঠীর সমালোচনার জবাবে ড.বেনজীর বলেন, ‘অনেকেই বলেন যে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি কেন স্বাধীনতার ঘোষণা করলো না। অনেকেই সমালোচনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলেছেন এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই সঙ্গে আরও একটা কথা বলেছেন মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতা সবসময় কিন্তু মুক্তি নিশ্চিত করে না। উনি মুক্তির প্রতিশ্রুতি ও আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন বাঙালি জাতিকে।’

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে এবং বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু যেটি চেয়েছিলেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যতামুক্ত আত্মমর্যাশীল জাতি গঠন। আমরা ক্ষুধাকে অলমোস্ট পরাজিত করেছি, আমরা দারিদ্রকে পরাজিত করার একদম দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি। আজকে বাংলাদেশ আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে জানান দিতে সক্ষম হচ্ছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বপ্নের সেই বাংলাদেশে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং সেই সাথে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের প্রতি তার যে ভালোবাসা, তার যে আত্মত্যাগ সেই বিষয়টিও এই অঞ্চলের মানুষ হাজার বছর ধরে স্মরণ করবে।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ে উঠছে
সভাপতির বক্তব্যে এসবি প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের ফলে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছি। এজন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে হাজার বছর ধরেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে এটি শেষ হবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন  প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত আত্মমর্যাদাশীল সেই জাতি হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে উঠছে।’

কালের আলো/এমএএএমকে