বঙ্গবন্ধু-বাঙালি অবিভাজ্য মেলবন্ধন: ইতিহাসের পাঠ ড. কামাল চৌধুরীর
প্রকাশিতঃ 1:50 pm | September 02, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অসীম প্রেরণার উৎস হয়ে নিজের অতুলনীয় নেতৃত্বগুণে পরাধীন জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তির মন্ত্রে। তাঁরই উদাত্ত আহ্বান সম্মোহিত করেছিলো সমগ্র জাতিকে। মুক্তির পথেই জাতি তাকে অনুসরণ করেছিল। বাঙালি জাতি এবং নিজের মধ্যে তিনি এক অবিভাজ্য মেলবন্ধন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
বেদনাবিধুর ১৫ আগস্টের কলঙ্কিত দিনে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আর সাম্রাজ্যবাদের এ দেশীয় দোসরদের যৌথ চক্রান্তে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধজয়ী জাতির গৌরবোজ্জ্বল ললাটে এক কলঙ্কতিলক কালরাত্রির নৃশংসতা। বাংলাদেশের জন্মে, বাঙালির চিন্তায়-চেতনায়-মুক্তি আর প্রাপ্তিতে উদ্ভাসিত নাম বঙ্গবন্ধু।
বাঙালি জাতির চির আরাধ্য পুরুষের সাহস, শৌর্য, আদর্শসহ বহুমাত্রিক জীবনের অনুপুঙ্খ এক বিশ্লেষণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
গত বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর রমনায় পুলিশ কনভেনশন হলে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবস ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানেই তিনি নবজাগরণের বার্তা নিয়ে নব অভ্যুদয়ের মাধ্যমে প্রজ্বলিত করেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষকে।
বঙ্গবন্ধু বহুমাত্রিক মানুষ, মহাকাব্যিক চরিত্র
ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একজন বহুমাত্রিক মানুষ। একজন মহাকাব্যিক চরিত্র। তাকে এই অল্প সময়ে তার জীবনের সকল অংশ, তাঁর অর্জন গৌরব কিংবা আত্মত্যাগের যে মহিমা সে মহিমার সকল অংশ ধারণ করা যাবে না। আমি সেজন্যে কিছু কিছু বিষয়ে আলোকপাত করবো। আমি জানি আপনারা এ বিষয়গুলোর সম্পর্কে ভালভাবেই অবহিত আছেন তবুও আমি আপনাদের সঙ্গে আমার যে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে ধারণা কিংবা বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে আমি যেভাবে ভাবি সেটুকু আমি চেষ্টা করবো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে।
আমি আমার বক্তব্যের শুরুতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বাঙালির স্বপ্ন আকাঙ্খার প্রতীক মানুষ যার তর্জুনীর ভরাভয়ে একদিন এই গাঙেয় বদ্বীপ জেগে উঠেছিল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশির মতো উর্মিমালায় একদিন জেগে উঠেছিল আমাদের জনপদ। আমাদের সেই আরাধ্য পুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ ভোর রাতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসাসহ যারা শহীদ হয়েছেন যারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য সকলকে আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। আমি স্মরণ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদকে যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। স্মরণ করছি ২ লক্ষাধিক মা বোনকে যাদের আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অংশ এবং তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা।’
কেন ‘শোক থেকে শক্তি, শোক থেকে জাগরণ’
‘শোক থেকে শক্তি, শোক থেকে জাগরণ’ এই প্রতিপাদ্যের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে আজকে যে আগস্ট মাস, এই আগস্ট মাসে আমাদের যে প্রতিপাদ্য সবাই এই প্রতিপাদ্যটি আপনারা ‘শোক থেকে শক্তি, শোক থেকে জাগরণ’ এই বিষয়কে সামনে রেখে আপনারা জাতীয় শোক দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী আপনারা পালন করছেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় তখন বাংলাদেশ ছিল ঘাতক কবলিত বাংলাদেশ।
বন্দুকের নলের নিচে, বেয়নেটের নিচে বাংলাদেশকে চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের যে প্রতিবাদের ভাষা আমাদের যে শোকের ভাষা সেটি আমরা প্রকাশ করতে পারিনি। কিন্তু আমরা সবাই জানি এক সময় প্রতিবাদের যে বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং শোক থেকে শক্তির যে জাগরণ ঘটেছে সেই জাগরণ আজকে বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় একটি সমুন্নত আসনে আসীন করেছে। আগামী দিনের যে স্বপ্নযাত্রা সেই স্বপ্নযাত্রায় আমরা, আপনি, আমি, আমরা সবাই আজকে শামিল। সেজন্যে এবার আমরা জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি থেকে আপনারা জানেন যে আমাদের যে জাতীয় কমিটি আছে সে জাতীয় কমিটির প্রধান হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আমরা তার অনুমতি নিয়ে জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভায় ‘আমরা শোক থেকে শক্তি, শোক থেকে জাগরণ’ এ বিষয়টাকে প্রতিপাদ্য হিসেবে ঠিক করেছিলাম। এবং পরবর্তীতে আমরা ড্রপডাউন ব্যানার হিসেবে আমরা দুটি ডিজাইন সকল জায়গায় সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠিয়েছি। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটি আমরা লক্ষ্য করেছি যে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল জায়গায় সারা বাংলাদেশে ‘শোক থেকে শক্তি, শোক থেকে জাগরণ’র বিষয়টি সেটি সম্প্রসারিত হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয় নিয়ে আজকে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন যে আয়োজনটা করেছে সেজন্য আমি আপনাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাই।

১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর মরদেহ নিয়ে হেলিকপ্টার যাত্রা করেছে। আমরা জানি যে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে যে মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, সে মর্যাদাও তাকে সমাহিত সে সময় করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন তার মরদেহকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাঙালি সেদিন শোক প্রকাশ করতে পারেনি। আমরা সেদিন শোক প্রকাশ করতে পারিনি। পৃথিবীতে বহু এরকম হত্যার উদাহরণ আছে, রাজনৈতিক হত্যার উদাহরণ আছে। রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার উদাহরণ আছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সে ধরনের ভয়াবহ হত্যার উদাহরণ পৃথিবীতে আর নেই।
আব্রাহাম লিংকনকে যখন হত্যা করা হয় আপনারা জানেন তখন তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তাকে নিয়ে যে শবযাত্রা শুরু হয়েছিল সেটি ওয়াশিংটন থেকে স্প্রিংফিল পর্যন্ত দুই সপ্তাহ সময় লেগেছিল এবং ট্রেনে করে তার মরদেহ নিয়ে যাত্রা হয়েছে। সেই সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটা লিখেছিলেন ওয়ার্ল্ডহুইটমেন। হুইটমেন লিখেছিলেন ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’।
তারপরে ট্রেনে করে তার মরদেহ নিয়ে যাত্রা হচ্ছে তখন তিনি আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন যেখানে আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যুকে লাইলাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যখন জনএফ কেনেডিকে হত্যা করা হয় ঠিক তারপরপর টাইম লিটারি সাপ্লিমেন্ট থেকে শুরু করে বহু জায়গায় অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। একইভাবে আমারিকার মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ পেয়েছে। যখন মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা করা হয় আপনারা অনেকেই জানেন যে, হত্যার খবরটি শুনে সঙ্গে সঙ্গে জওহরলাল নেহেরু ছুটে গিয়েছিলেন এবং তিনি যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তখন মিডিয়ার সামনে যে কথাগুলো বলেছিলেন তার একটি কথা খুবই বিখ্যাত। সেটি হচ্ছে তিনি বলেছিলেন, ‘সকল বাতি নিভে গেছে’। আমাদেরও সকল বাতি নিভে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে কিন্তু যেভাবে আব্রাহাম লিংকনকে বা জনএফ কেনেডি কিংবা মহাত্মা গান্ধিকে তার দেশের মানুষ শেষ যাত্রায় শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছে আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা সেভাবে জানাতে পারিনি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু আর এক মহিয়ান মৃত্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে। যে মৃত্যুকে বন্দুকের নলের নিচে প্রতিবাদের ভাষাকে স্তব্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু সেটি একটি ভিন্নমাত্রায় বহু মাত্রিকতায় সারা পৃথিবীতে আজ উদ্ভাসিত। আজ বঙ্গবন্ধু চিরন্তন বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছেন। আর সেই যে ১৬ আগস্টে হেলিকপ্টারে মরদেহ নিয়ে যাওয়া আজও কিন্তু আমাদের সে শোকযাত্রা শেষ হয়নি।
আজকে আমরা সবাই এই মুজিববর্ষে এবং আগামী দিনেও মুজিব চিরন্তন এই আলোক শিখায় উদ্ভাসিত হয়ে আমরা যেন রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছি দু’সপ্তাহ নয়, দু’বছর নয়, শত বছর নয়, আগামী দিনের হাজার বছর পেরিয়েও বাঙালি যতদিন বেঁচে থাকবে এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে আমরা এভাবেই আমাদের এই চিরন্তন শোক, আমাদের এই ভালোবাসা প্রকাশ করবো। তাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা কখনও শেষ হবে না। মুজিব চিরন্তন এক আলোক শিখা সেই আলোক শিখা বলেই আজকে ‘শোক থেকে শক্তি, শোক থেকে জাগরণ’।
ইতিহাস চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে লালন
ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘১৯৮১ সালে ১৭ মে জাতির পিতার কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর সেই সাহসের বৈজয়ন্তী হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং অকোতভয়ে বাঙালিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে তিনি আজকে বাংলাদেশকে একটা সমুন্নত আসনে আসীন করেছেন। আজকে আমরা মনে করি, এই শোক থেকে আমরা যে শক্তিটা ধারণ করবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজকে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছেন আমরা সেই স্বপ্ন যাত্রায় সেই শক্তি দিয়েই শামিল হবো এইটুকু আমি মনে করি।
বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি। বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আমি অনেকের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি। কিন্তু আমরা অনেকেই আসলে বিষয়টা ভাল করে ব্যাখ্যা করতে পারি না। অনেকেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বললেই কিংবা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বললেই তারা বিবিসিতে বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল এরকম একটা উত্তর তারা দেন। বিবিসি বঙ্গবন্ধুকে যথার্থই আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে আমাদের হৃদয়ে লালন করবো তখন আমাদের ইতিহাস চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে লালন করতে হবে। যাতে আমরা বুঝতে পারি, আসলে আমরা যে কথাটা বলছি সেটি শুধু কথা নয়, কথামালা নয় সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষ।’

বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন বঙ্গবন্ধু
প্রধান আলোচকের বক্তৃতায় ড.নাসের আরও বলেন, ‘বাঙালির ইতিহাস যদি আমি পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা দেখবো যে, আমরা যখন চর্যাপদ থেকে হিসাব করি যখন বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বা সেভাবে হিসেব করা হয় ভাষাবিজ্ঞানীরা সেভাবেই করেন সেই হিসাবে যদি ধরি তাহলে আমাদের হাজার বছর কিন্তু পেরিয়ে গেছে। হাজার বছরতো আসলে একটা চলমান বিষয় আগামীতে দু’হাজার বছর, তিন হাজার বছর এভাবে চলতে থাকবে। এই অতিক্রান্ত যে সময় সেই সময় আসলে সর্বকালের বা সর্বযুগের যদি বলি তাহলে হয়তো আমাদের ক্যানভাসটি যথাযথ থাকে।
যদি আমরা সেভাবেও বিষয়টা রাখি তাহলে আমরা দেখবো যে এই উপমহাদেশে বাঙালিরা কিন্তু সব সময় অগ্রসর জনগোষ্ঠী। বাঙালিদের ভেতর অনেক বড় নেতা এসেছেন এবং এই উপমহাদেশে যখন আমরা যেটাকে বলি জাগরণ আবার কেউ কেউ নবজাগরণ বলে উনিশ শতকের যে জাগরণ। যেটি রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কিংবা পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলাম বা বেগম রোকেয়া তাদেরকেও আমরা ধরতে পারি। সেই সময়ে যে জাগরণটা হয়েছিল সেটি কিছুটা বাঙালিদের হাতে কিছুটা উইলিয়াম জোনদের মতো যিনি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের সমন্বয়ে এই জাগরণটি হয়েছিল।
কিন্তু বাঙালিদের মধ্যেই এই উপমহাদেশের প্রথম জাগরণটা হয়েছিল। এবং সেজন্যে গোফেলের যে বলেছেন, ‘হুয়াট বেঙ্গল থিংস টুডে রেস্ট অফ ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমোরো। যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি। আপনারা জানেন সেই সময়ও কিন্তু ভারতের সুরুন্দাত ব্যানার্জি যাকে বলা হত ভারত পথিক, খুবই বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এরকম অনেকেই ছিলেন বাঙালিদের ভেতরে। আমরা জানি যে চেগুয়েভারা সারা পৃথিবীতে।
মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেটাও কিন্তু বাঙালিদের হাতে হয়েছে এবং সেটি ঢাকা হয়েছে আপনারা জানেন। এবং আজকে ভারতে যে দলটি ক্ষমতায় সেই দলটির উৎপত্তির পেছনে কিন্তু বাঙালিরা অর্থাৎ প্রথম যে দলটি গঠিত হয়েছিল অর্থাৎ যেটি ভেঙ্গে আজকে এই বিজেপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটিও কিন্তু বাঙালিদের হাতে। বাঙালিরা কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে সব সময় একটি বড় আসন বা অবস্থান তারা নিজেরা সুদৃঢ় করে রেখেছেন। বাঙালিদের ভেতরে আমরা বহু বড় বিপ্লবী দেখেছি।
আমি উদাহরণ দেই- শেরপুরে টিপু সাহা নামে একজন বিপ্লবী ছিলেন। তিনি শেরপুরের একটি অংশকে সেই সময় মুক্ত রেখেছিলেন। তাকে নিয়ে একটি বিখ্যাত বইও লেখা হয়েছে- ‘ইমান ও নিশান’। আমরা সূর্যসেনের কথা জানি, আমরা বিনয় বাদল দীনেশের কথা জানি, আমরা তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ’র কথা জানি, ক্ষুদিরামসহ অনেক বিপ্লবীর কথা আমর জানি। যারা বিপ্লবের ইতিহাসে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমরা যখন পৃথিবীতে বিপ্লবীদের কথা বলতে যাই তখন ঘুরে ফিরে একটি নাম চলে আসে, সেটি হচ্ছে চেগুয়েভারা। চেগুয়েভারা ১৯৫০ সালে একটি মোটরসাইকেল জার্নি করেছিলেন। তার বন্ধু আলবেরেজকে নিয়ে। ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবের পরিস্থিতি দেখার জন্য।
পরবর্তীতে তিনি বিপ্লবে মৃত্যুবরণ করেন, বলিভিয়াতে যুদ্ধ করতে গিয়ে। তারও বহু আগে আমি যাদের নাম বললাম, বাঙালিরা কিন্তু বিপ্লবী। চেগুয়েভারারও বহু আগে যে ক’জনের নাম বললাম তারা প্রত্যেকে কিন্তু চেগুয়েভারার আগে বিপ্লবী। অর্থাৎ বিপ্লবের যদি ইতিহাসও ধরি বাঙালিরা কিন্তু অনেক অগ্রসর। তারপর আমরা সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক- এরকম অনেক বড় নেতা বাংলায় জন্ম নিয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের কোন জাতি রাষ্ট্র কেউ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এই জাতি রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

বাঙালিকে ঠিকানা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুই
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এই মুখ্য সচিব বলেন, ‘বাঙালিরা সারা পৃথিবীতে হচ্ছে তৃতীয় বৃহত্তম জাতিসত্ত্বা। আমরা কিন্তু সবাই যখন বলি বাঙালিরা হচ্ছে সপ্তম। আসলে ভাষার দুটো দিক, প্রথমত ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতের বাহন। আমরা যখন বলি আমি ভাত খাই। তখন আমি কিন্তু আমার সংস্কৃতকে প্রতিফলিত করি। বাঙালিরা আমাদের নদ-নদী, আমাদের জীবনকে তৈরি করেছে এটা আমার কথা নয় এটা হচ্ছে ঐতিহাসিক নিহার রঞ্জন রায়ের কথা।
আমাদের ভেতরে যে মৌল ব্যক্তিত্বের কাঠামো, যেটাকে এনথ্রোপলজি কিংবা সাইকোলজিতে বলে বেসিক পারসোনালিটিজ ষ্ট্রাকচার। বাঙালিদের ভেতর কমন অনেকগুলো জিনিস আসে। প্রত্যেকটা জাতিসত্ত্বারই সেরকম আছে। এগুলো কিন্তু তৈরি হয়েছে আমাদের ভাষা, সংস্কৃত সব কিছু মিলিয়ে। ভাষার সব থেকে বড় একটা দিক হচ্ছে, ভাষা ন্যাশনাল, জাতীয় একটা বিষয় এবং সেটি হচ্ছে ভাষা সংস্কৃতের বাহন।
আবার আরেকদিকে ভাষা হচ্ছে কমিউনিকেশনের মাধ্যম। যেমন আমরা ইংরেজি বা অন্য কোন ভাষায় কথা বলি আমরা কিন্তু কমিউনিকেট করতে চায় আরেকজনের সাথে। যদি জাতিসত্ত্বার ভাষা হিসেবে ধরি, তাহলে বাঙালিরা হচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম জাতিসত্ত্বা এবং চীনের হানরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জাতিসত্ত্বা। তারপরে যদি আমরা ধরি তাহলে আরব জাতিসত্ত্বাকে ধরতে পারবো। কারণ আরবদের অনেকগুলো রাষ্ট্র আছে। চীনেরও তাইওয়ানে, এমনকি সিঙ্গাপুরেও তাদের বেশি সংখ্যক অধিবাসী।
কিন্তু বাঙালির কোন দেশ ছিলো না, বাঙালির কোন ঠিকানা ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ্ই সর্বকালের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি, যিনি বাঙালিকে একটি ঠিকানা দিয়েছেন, একটি ল্যাংগুজটিক ন্যাশনালিজমের ভিত্তিতে বাঙালিদের ঠিকানাটা তৈরি করেছেন। একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি রাষ্ট্র তৈরি করেছেন বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি।’
জেনারেলদের একটি সভায় ইয়াহিয়ার প্রশ্ন
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। এটি আবদুস সেলিমের বইতে আছে, তিনি লিখেছেন- জেনারেলদের একটি সভায় ইয়াহিয়া জিজ্ঞেস করছে, শেখ মুজিবকে কী আমি গুলি করে হত্যা করবো? নাকি বিচার করে গুলি করে হত্যা করবো, আপনারা বলেন। জেনারেলরা বললো- আপনি গুলি করে হত্যা করেন বা বিচার করে হত্যা করেন যেভাবে হোক আপনাকে হত্যা করতে হবে, ব্যাপারটি এরকম। কিন্তু পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি।
তাকে যখন লায়েলপুর জেলখানা থেকে পরবর্তীতে মিয়াওয়ালি জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে সেখানেও তাকে হত্যা করার জন্য তার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আপনারা জানেন যে, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার ভেতরে সুস্পষ্টভাবে এ কথাটা বলেছেন যে, আমার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তারা হত্যা করতে পারেনি।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য যে চেষ্টাটাই ইয়াহিয়া খান করেছিল সেই সময় সারা পৃথিবী কিন্তু এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টার প্রতিবাদ করেছিল। সেই সময়টায় কলকাতায় জুলাই মাসের দিকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তিনি এসে অন্নদাশঙ্কর রায়, আপনারা জানেন যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবচেয়ে উদ্ধৃত, সবচেয়ে পঠিত যে কবিতা সেটি হচ্ছে- ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরি মেঘনা বহমান’। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবি অন্নদাশঙ্কর রায়কে এসে বললেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে। এরকম একটি খবর বের হয়েছে, আমরা একটি প্রতিবাদ সভা করবো। আপনি যদি একটু গড়ের মাঠে আসেন। গড়ের মাঠে গেলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। কিন্তু তিনি সেখানে আর ঢুকতে পারলেন না, কারণ এতো লোক সেখানে জড়ো হয়েছে। তিনি ফেরত আসলেন এবং ফিরে এসে বাসায় এসে লিখলেন সেদিন- ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরি মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’ অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেও কিন্তু আরেকটি কবিতা লিখেছিলেন, নরহত্যা মহাপাপ।
অন্নদাশঙ্কর রায় একটি জায়গায় লিখেছেন- পাকিস্তানিরা কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু বাঙালিদের হাতেই তিনি শাহাদাতবরণ করেছেন। বঙ্গোপসাগরের সকল জল দিয়েও যদি, আমরা আমাদের হাত প্রক্ষালণ করি, হাত ধৌত করি তাহলেও কিন্তু এই রক্ত যাবেনা, এই শোক যাবেনা। আসলে এই শোকটায়, ওই চিরকালীন শোকের যে জায়গা সেটি কিন্তু আমরা এভাবেই প্রতিদিন, প্রাত্যহিকভাবে পালন করছি।’

‘রাজনীতির কবি’ বঙ্গবন্ধু
সাবেক মুখ্য সচিব বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব মিডিয়ায় ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আমি অনেক খোঁজ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এই অভিধায় আর কাউকে আখ্যায়িত করা হয়েছে বলে আমার এখনও চোখে পড়েনি। কিন্তু কেন বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন? আমাদের ইতিহাসের অনেক প্রলম্ব নেতার কথা আমি বলেছি। যেমন, আজাদ হিন্দ ফোর্সের সিঙ্গাপুর থেকে যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। সুভাষ চন্দ্র বসুর বক্তৃতার শেষ লাইনটা ছিল- ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও’। শেষে ‘আই প্রমিজ ফ্রিডম, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিবো। তখনও ভারতবাসী কিংবা বাঙালিরা প্রস্তুত হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যখন ভাষণটা দিচ্ছেন তিনি কিন্তু কারও কাছে রক্ত চাইছেন না। বঙ্গবন্ধু বলছেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এই দুটো কথার মাঝে পার্থক্য আছে।
একজন ব্যক্তি আহ্বান করছেন, একজন নেতা আহ্বান করছেন। আর বঙ্গবন্ধুর জায়গায় এসে ব্যক্তি নেই, নেতা নেই একটি জাতি আহ্বান করছে। একজন মানুষ যিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন মাইক্রোফোনের সামনে, তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন জাতিতে। আপনারা লক্ষ্য করবেন সেদিন, জাতি এবং বঙ্গবন্ধুর ভেতরে কোন ফারাক ছিলো না। একটি অবিভাজ্য মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে বলেই তিনি সর্বনাম মুছে দিয়েছিলেন এবং সবাইকে সেভাবেই আখ্যা দিয়েছিলেন- তোমরা প্রস্তুত থাকো সকল নির্দেশ। আমি কথাটা খুব সচেতনভাবে বলছি। যেমন : ভারত উপমহাদেশেও কিন্তু অনেক বড় নেতার আবির্ভাব ঘটেছিল।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক তার একটি বক্তৃতায় খুবই চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে গান্ধী, জিন্নাহ বড় বড় অনেক নেতা এসেছিলেন। কিন্তু কোন জাতিকে এভাবে রিপ্রেজেন্ট করে নাই। একটা জাতি একজন ব্যক্তির কথা এভাবে শোনেছেন আসলে সেই ইতিহাস পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু সেদিন সার্বভৌম বাঙালি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
সার্বভৌমত্বের যে থিউরিটিক্যাল যে ধারণাটা, সেটি কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে আগে ছিলো না। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক স্বাধীন নৃপতি ছিলেন। আমরা ভুল করে অনেক সময় বলি- ইলিয়াস শাহ স্বাধীন ছিলেন, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ স্বাধীন ছিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলাকেও অনেক সময় স্বাধীন বলি। কিন্তু স্বাধীনতার সাথে যে সার্বভৌমত্বের বিষয়টি জড়িত। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন, প্রথম সার্বভৌম শাসক এবং বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই অর্থে প্রথম স্বাধীন শাসক। যদিও ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতান ছিলেন তবে সার্বভৌম সুলতান ছিলেন না। যদি সার্বভৌম সুলতান হতেন তাহলে দিল্লীর বাদশা এসে তাকে আক্রমণ করতে পারতেন না এবং তিনি দুর্গে আশ্রয় নিতেন না এবং সারা পৃথিবী এর প্রতিবাদ করতো। আজকে কারও যদি স্বাধীনতা সামান্য ক্ষুন্ন হতে যায়, সারা পৃথিবী কিন্তু হৈ চৈ শুরু করে। এটাই হচ্ছে সার্বভৌমত্বের একটি বড় উদাহরণ।’
বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম মানুষ
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যখন বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিচ্ছেন- আপনারা লক্ষ করবেন, সেদিন সরকারি অফিস কি খুলেছিল? বন্ধ। হাইকোর্ট বন্ধ, পুলিশও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদেশে কাজ করেছে। বাঙালিরা প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর আদেশে কাজ করেছে। তার অথর্টা দাঁড়াচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম একজন সার্বভৌম বাঙালি, সার্বভৌম মানুষ, সার্বভৌম নেতা আবির্ভূত হয়েছিলেন যার কথা অক্ষরে অক্ষরে জাতি পালন করেছে। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র বাঙালির ক্ষেত্রে নন, বঙ্গবন্ধু এই উপমহাদেশে এবং বিশ্ব মানচিত্রে একজন আলাদা রকম মানুষ এবং রাজনীতির কবি হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু র্যাডিকেল ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন ধরে যে রাজনীতিটা করেছেন সে রাজনীতি ছিল মানুষের রাজনীতি। সে রাজনীতি ছিল অসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি, সে রাজনীতি ছিল সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে উদার নৈতিক রাজনীতি। খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন, বইটার নাম ‘মুজিববাদ’। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, আপনি তো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে রাজনীতি করেন। এই জাতীয়তাবাদের যে আন্দোলন সারা পৃথিবীতে যেসব ঘটেছে, সেখানে কিন্তু নেচিবাচক অনেক উদাহরণ আছে। হিটলারও জাতীয়তাবাদী ছিলেন, ফাঙ্কোও জাতীয়তাবাদী ছিলেন, মুসোলিনিও জাতীয়তাবাদী ছিলেন।
আপনি জাতীয়তাবাদকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? সুস্পষ্ট প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, প্রগতিশীলতার জাতীয়তাবাদ, আমার জাতীয়তাবাদ হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক, সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ। এবং তিনি বলেছেন, আমি জানি, জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতার ইতিহাস আমার জানা আছে এবং আমি বিশ্বাস করি বৈষম্যের বিরুদ্ধে যদি আমাদের অর্জনটিকে সামনের দিকে নিয়ে আসতে পারি, আমরা যদি অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র যেভাবে আমরা কাজ করছি সেটি যদি চূড়ান্ত অর্থে আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের এই জাতীয়তাবাদ একটি আন্তর্জাতিকতাবাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কাছে পৌঁছাতে পারবে।
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যে বলেছেন, সমগ্র মানবজাতিকে নিয়ে আমি ভাবি, বাঙালিকে নিয়ে আমি ভাবি। লক্ষ্য করবেন কলকাতার জীবন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু কিন্তু তার জাতীয়তাবাদের মধ্যে মানবতাবাদ, উদার নৈতিক যে জাতীয়তাবাদ সবকিছু লালন করতেন বলেই বঙ্গবন্ধু রেডিক্যাল ছিলেন না। পৃথিবীতে অনেকগুলো দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আপনারা জানেন বিপ্লবের মাধ্যমে একটি উদাহরণ। খুবই বিখ্যাত ঐতিহাসিক এরিক হবসন, তিনি এটিকে বলেছেন ‘এইজ অব রিভুলেশন’ অর্থাৎ সেই সময়ে যেমন- সিমোন বোলিভার ল্যাটিন আমেরিকার জনক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ফরাসি বিপ্লব হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবকে আমরা যদি ধরি, তাহলে দেখবো তারপরে কী ঘটেছে।
ফরাসি বিপ্লব কিন্তু খুবই একটি বড় ঘটনা, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার যে বাণীটা দিয়ে এসেছিল। পরবর্তী দু’বছরে ফরাসি বিপ্লব যে টা ছিল রোবস্পিয়ার। তারা যারা ফরাসি বিপ্লবের তরুণ, কারণ তাদের কারও পয়ত্রিশ, চল্লিশের বেশি বয়স কারও ছিল না। পরবর্তীতে রোবস্পিয়ার ফরাসি বিপ্লবের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার আরেকজন সহযোগী ছিল তার নাম ছিল সেইন্ট জাস্ট। সেইন্ট জাস্টকে বলা হতো ‘এঞ্জেল অফ ডেথ’। অর্থাৎ যারা বিপ্লবের বিরোধীতা করছে, যারা নীতির বাইরে যাচ্ছে তাদের সবাইকে শেষ করে দাও। তারা বহু মানুষকে হত্যা করেছে। একইভাবে অনেক ঘটনা আমরা জানি, চীনের সংস্কৃতি বিপ্লবের সময় বহু মানুষ হয়রানি হয়েছে। পরবর্তীতে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ফ্রাঙ্কো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে রিপাকলিকানদের দমিয়ে ফেলেছিল, অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমরা এসব ইতিহাস জানি।
বঙ্গবন্ধু মানবতাবাদী ছিলেন, উদারনৈতিক ছিলেন
ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু বঙ্গবন্ধু মানবতাবাদী ছিলেন, উদারনৈতিক ছিলেন; তিনি গণতন্ত্রকে সামনে নিয়ে তিনি প্রথম সকলের অধিকার সমুন্নত করার জন্য এই সংবিধান দিয়েছেন এবং সবকিছু মিলিয়ে একটি সমন্বয়বাদীতার মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। সেই সময় থেকে আমরা জানি, আমাদের দেশের ঘটনাগুলো হয়েছিল উল্টো। যারা নিজেদের মার্কসবাদী, লেনিনবাদী কম্যুনিস্ট মনে করতো, যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধুকে একটি সময়ে এই পরামর্শ পর্যন্ত দিয়েছিল- আপনি সবকিছু বন্ধ করে জরুরি অবস্থা জারি করে সর্বময় ক্ষমতা আপনার হাতে নেন। যারা বিরোধিতা করেছে তাদের গুলি করে হত্যা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমি সারাজীবন রাজনীতি করেছি মানুষের জন্য, সাধারণ মানুষের রাজনীতি করেছি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমি রাজনীতি করেছি। আমি সবাইকে নিয়ে সমন্বয়ের রাজনীতি করতে চাই। কিন্তু তখন আপনারা যারা পুলিশ বাহিনীর সদস্য আছেন, আপনারা জানেন কী ধরণের অরাজকতা, কী ধরণের সন্ত্রাস করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে সারা বিশ্বের কাছে একটি অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা, ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা হয়েছে। আপনারা জানেন যে, ভুট্রোর কাছে পর্যন্ত অস্ত্র চাওয়া, তখন সিরাজ শিকদারের দল, আবদুল হকের দল এমন বহু লোক কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।
এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন তখন কিন্তু এরকম তথাকথিত কম্যুনিস্ট তারা কিন্তু অস্ত্র জমা দেননি। সারাদেশে তারা সন্ত্রাস করার চেষ্টা করেছে। তখন পুলিশ বাহিনীকে কী রকম কষ্ট করতে হয়েছে আপনারা জাস্ট একটু অনুধাবন করে দেখেন। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তারপরেও সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় যে কাজ করেছেন। আজও যখন আমরা দেখি ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে ফিনিক্স পাখির মতো একটি দেশকে তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। আজকে আমরা দেখছি সকল কিছুর পেছনেই কিন্তু বঙ্গবন্ধু। আজকে যে আমাদের সোনার বাংলার স্বপ্নযাত্রা, এটার ভিত্তি কিন্তু আমাদের বঙ্গবন্ধু তৈরি করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সার্বিকভাবে যখন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন আপনারা জানেন, সে সময় তিনি বলেছিলেন এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে একটি নতুন চিন্তা, নতুন সিস্টেমকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন এই সিস্টেমের মাধ্যমে মানুষের সার্বিক মুক্তি, বাঙালির সার্বিক মুক্তি।
ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা ৭১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই আমি বলবো তারা তারা যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সেই ষড়যন্ত্র কিন্তু শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে আমরা কখনো কখনো বলি কিছু বিপদগামীরা। আসলে বিপদগামী কথাটা আমি মনে করি যথোপযুক্ত নয়। কারণ এর পেছনে একটি গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। যে ষড়যন্ত্র আসলে বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চের সেই গণহত্যার রাতে অর্থাৎ, ২৬ মার্চে গ্রেফতার করে পাকিস্তানীরা যে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র এটার সাথে সম্পৃক্ত ছিল, বাংলাদেশেও কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র হয়েছে। এজন্য আজ কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। আমরা বিশ্বাস করি কারা কারা ষড়যন্ত্রকারী ছিল তাদের মুখোশ একদিন উন্মোচিত হবে। আজকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সবার ধন্যবাদ জানাতে হয় যে, কী সাহসে তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো।
বিচারটাকে স্বাভাবিক বিচারের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আজকে কিন্তু খুনিদের বিচার হয়েছে। কিছু খুনির ফাঁসি হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস আগামীতে অন্যান্য যারা এখনও পলাতক আছে তারাও চূড়ান্ত বিচারের মুখোমুখি হবে। এটার সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী যারা জড়িত ছিল তাদেরও একদিন মুখোশ উন্মোচিত হবে, এই আমাদের বিশ্বাস। যদি আমরা এই কাজগুলো করতে পারি, তাহলে আমরা মনে করি আগামী দিনের সত্যিকার অর্থে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার যে মিছিলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, জাতির পিতার প্রতি আমরা সেই মিছিল থেকে আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারবো।
আমি ১৯৭৮ সালে আমার লেখা একটি কবিতার ৪টি লাইন শুনিয়ে শেষ করছি- ‘যেখানে ঘুমিয়ে আছে, শুয়ে থাকো বাঙালির মহান জনক। দাও শুধু প্রিয় কণ্ঠ, সূর্য আর অমিত সাহস। টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো তোমার সাহস নিবে, নেবে ফের বিপ্লবের মহান প্রেরণা।
কালের আলো/জিকেএম/এমএএএমকে