পরেশ বড়ুয়া ‘গুজব’ কী লিখেছে আনন্দ বাজার?

প্রকাশিতঃ 12:27 am | November 08, 2018

কালের আলো ডেস্ক:

দেওয়ালির সকাল। ছুটির দিন। বুধবার হঠাৎ করেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে যে পরেশ বড়ুয়াকে হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে এ দেশের পুলিশ-সেনা, তারই মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়! চীন-মায়ানমার সীমান্তের কোনও অজ্ঞাত রাস্তায় ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে খবর আসে।

মুহূর্তের মধ্যেই আসামে খবরের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে টেলিভিশন চ্যানেলে শিরোনাম হয়ে যায় পরেশের ‘মৃত্যু’র খবর।

১৮ বছর আগে ঠিক এমনই একটা খবর ভেসে উঠেছিল আসামে। ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। সেটাও ছিল একটা ছুটির দিন, রবিবার। রাজ্য জুড়ে তখন একের পর এক হত্যালীলা, হামলা চালাচ্ছে পরেশের উলফা। ইন্টারনেট বা টেলিভিশনের এতটা প্রসার ছিল না তখন। তা সত্ত্বেও সে দিন একই রকম ভাবে গোটা আসাম জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল— বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি-মেইছড়ির রাস্তায় খুন হয়েছেন পরেশ। সঙ্গে তাঁর তখনকার ঘনিষ্ঠতম সহযোগী রাজু বরাও। সে দিন আসাম রাইফেলসের ত্রিপুরা শিবির থেকে বলা হয়েছিল, তারাও একই খবর পেয়েছে। এ দিনের মতো সে দিনও সেনা গোয়েন্দা থেকে পুলিশের একাংশ দাবি করেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র জনজাতি সংগঠন শান্তিবাহিনীর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন একটি অংশের হাতে খুন হয়েছেন শীর্ষ ওই দুই উলফা নেতা।

এই দুই ঘটনার মিলের কথা শুনেই দিল্লিতে বসে কেন্দ্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার উত্তরপূর্ব ডেস্কের এক আধিকারিক এ দিন দুপুরে মনে করিয়ে দিলেন আরও একটা মিল। তিনি জানালেন, ২০০০ সালে ওই ঘটনা ঘটার ঠিক ১০ দিন আগে, আসামের তিনসুকিয়া জেলার সদিয়ায় ট্রাক থামিয়ে ২৮ জন হিন্দিভাষী মজুর, ছোট ব্যবসায়ী এবং চাষিকে গুলি করে মেরেছিল সন্দেহভাজন উলফার জঙ্গিরা। ওই ঘটনারও কোনও দায় নেয়নি উলফা। যেমন, এ বারও পরেশের উলফা সদিয়ার ধলাতে পাঁচ বাঙালি খুনের দায় নেয়নি!

এ দিন ঠিক কী হয়েছে?

সকালে আসামের দু’টি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে পরেশের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হতেই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে যায় আলোচনা। আসামের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খবর দেখানো শুরু হতেই শোরগোল পড়ে যায় কাকোপাথারে উলফার আলোচনাপন্থীদের ডেজিগনেটেড ক্যাম্পে। আলোচনাপন্থী নেতারা অনেকেই স্বীকার করেন, এখনও ওই ক্যাম্পের অধিকাংশ ক্যাডারই পরেশকে নেতা মেনে চলেন। অন্য দিকে, দিসপুরে আসাম পুলিশের সদর দফতরেও ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। আসাম পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান পল্লব ভট্টাচার্য সকাল থেকেই খবরের সত্যতা সরাসরি স্বীকার না করলেও অস্বীকার করেননি।

সূত্রের খবর, শিলংয়ে আসাম রাইফেলসের সদর দফতর থেকে কর্নেল পদমর্যাদার এক আধিকারিক তাঁর মায়ানমার সীমান্তের ওপারে থাকা ‘সোর্স’দের কাছে ফোন করেও সেই খবরের সত্যতা জানতে পারেন। সেনা গোয়েন্দাদের একটা অংশ দাবি করেন, তাঁরাও সীমান্তের ওপারে টাগাতে থাকা বিভিন্ন সূত্র মারফৎ একটি দুর্ঘটনার খবর পেয়েছেন। তাঁদের একটা অংশ দাবি করেন, পরেশ চিন-মায়ানমার সীমান্তের রুইলি থেকে উত্তর মায়ানমারের টাগাতে যাচ্ছিলেন। সেই পথেই নাকি দুর্ঘটনা ঘটে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসরে নামেন আলোচনাপন্থী উলফা নেতারা। অনুপ চেতিয়া আনন্দবাদার ডিজিটালকে বলেন, “পরেশ বড়ুয়া মারা গিয়েছেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। একমাস আগেই আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত লেগেছিল। এখন তিনি সুস্থ রয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন।” আসাম পুলিশ থেকে উলফা নেতা-কর্মীরা সবাই ভাল ভাবেই জানেন, আলোচনাপন্থীদের মধ্যে একমাত্র অনুপের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রয়েছে পরেশের। দূর সম্পর্কের খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন পরেশও। তাই অনুপের বয়ান সামনে আসতেই ফের গোটা রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে যায় সংশয়।

এ সবের মধ্যেই পরেশের বড়দা বিমল বড়ুয়ার সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করে। তিনিও জানিয়ে দেন, তাঁর কাছে এ রকম কোনও খবর এসে পৌঁছয়নি।

সংশয়ের অনেকটা অবসান হয় দুপুর গড়াতেই। উলফার বর্তমান মুখপাত্র রোমেল অসমের সই করা বিবৃতি চলে আসে সংবাদমাধ্যমের কাছে। বলা হয়, পরেশ সুস্থ আছেন। তাঁর মৃত্যু এবং দুর্ঘটনার খবর ভুয়ো। কিছু মানুষ উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই খবর ছড়িয়েছে।

কিন্তু কে এই ভুয়ো খবর ছড়াল? কারণই বা কী?

দিল্লির ওই গোয়েন্দা আধিকারিক মনে করিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একাধিক বার ওসামা বিন লাদেনের সম্ভাব্য মৃত্যুর ভুয়ো খবরের প্রসঙ্গ। তাঁর কথায়, “জঙ্গি সংগঠন এবং নিরাপত্তা বাহিনী-গোয়েন্দাদের লড়াইয়ে এ ধরনের ভুয়ো খবর ভাসিয়ে দেওয়া একটা মস্ত হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার প্রয়োজন মতো দু’পক্ষই কিন্তু ব্যবহার করে।”

আসামের এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “ডিব্রুগড়ের চাবুয়া থানা এলাকায় এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। ওই ব্যক্তির কাছে রোমেল অসম মেসেজ করে জানিয়েছেন যে, পরেশ ভাল আছেন।” পুলিশ সূত্রে খবর, এ রকম আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ওই পুলিশ আধিকারিকের ব্যাখ্যা, এ ধরনের খবর ছড়ালেই, আমাদের চার পাশে উলফা বা পরেশের যে ‘সোর্স’ বা যোগাযোগ লুকিয়ে আছে তাঁদের চিহ্নিত করা সোজা হয়। অন্য দিকে, জঙ্গি নেতারাও একই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষানজি খুব উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই লালগড়ের হাতিলোটের জঙ্গলে তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘিরে সংশয় রেখে দিয়েছিলেন। পরেশও ঠিক একই ভাবে ধলার ঘটনার পর, এই খবর ছড়িয়ে আসামের মাটিতে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা সরেজমিনে দেখলেন, এমনটাও হতে পারে বলে মনে করছেন কিছু পুলিশ আধিকারিক।

সব মিলিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট, মৃত্যু না হলেও, আড়াই মাস আগে পরেশ বড়ুয়া পথ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন।