মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকছে

প্রকাশিতঃ 3:29 pm | January 25, 2018

কালের আলো ডেস্ক:

১৯ জানুয়ারী ‘১৮ সকাল অনুমান সাড়ে এগারটা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনের চত্ত্বরে মাঝ বয়সী একদল তরুন তরুনী এখানে সেখানে বসে ধুমসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউবা হৈ হৈ করে অন্য বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে বলছে, “বন্ধু, কেমন আছিস বল!” একজন মাইক্রোফোনে কখনও চীৎকার করে সবাইকে ডাকছে রেজিস্ট্রেশন করতে কখনওবা মোবাইল থেকে পুরানো দিনের বাংলা হিন্দী গান বাজাচ্ছে। মাঝে মাঝে দলধরে সেলফি তোলা হচ্ছে। কলতান কলরবের মাঝে পুরাতন বন্ধুর সাথে নতুন করে পরিচয় হচ্ছে। পরিচয় হচ্ছে তাদের পরিবারের সংগেও। ক্ষনে ক্ষনে ভীড় বাড়ছে। মধ্য বয়সী এসব তরুণ তরুণীরা সবাই ‘৮০-‘৮১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্র ছাত্রী। আজ তারা প্রায় ৩১ বছর পর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একত্রিত হয়েছে। সবাই মিলেছে প্রাণের আনন্দে। ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের পুরানো দিনগুলোতে। তাইতো মধ্য বয়সী হলেও আজ তারা সবাই প্রানোচ্ছ্বল তরুণ তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম দিনটির মত। এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, কেউ প্রতিষ্ঠান প্রধান, কেউবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কর্মকর্তা, কেউবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নেতা-কর্তা বা সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু তাদের সকল পরিচয় ছাপিয়ে আজ তারা ‘৮০-‘৮১ ব্যাচের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বন্ধু। ভাগ্যক্রমে আমিও ছিলাম সেসব মাঝ বয়সী তরুণ তরুণীদের একজন।

গত ১৯ -২০ জানুয়ারি ছিল আমাদের অর্থাৎ ‘৮০-‘৮১ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ব্যাচের পুনর্মিলনী। আমরা প্রায় দু’শত জন বন্ধু একত্রে হয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকে বিদেশ থেকেও এসেছিলো এ উপলক্ষে। রেজিস্ট্রেশন দিয়ে অনুষ্ঠানমালার শুভ সূচনা। জুম্মার নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট হাউজ সংলগ্ন কম্যুনিটি সেন্টারে লাঞ্চ। এরপর আশে পাশে ঘুরাঘুরি। চারটায় ভাইস চ্যান্সেলার কর্তৃক পুনর্মিলনীর শুভ উদ্বোধন ও আনন্দ শোভা যাত্রা। ব্যান্ডের তালে তালে চলে নেচে গেয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস। শোভাযাত্রা শেষে ছিল পিঠা উৎসব। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, জিলিপি ও কফি ছিল দেদার। এসবের ফাঁকে ফাঁকে ছিল দলবেঁধে হাসি আড্ডা, ছবি তোলা। সূর্যাস্তের সংগে সংগে পুরো চত্ত্বর ঝলমল হয়ে জ্বলে উঠেছে বর্ণিল আলোর ঝর্ণা ধারায়। সন্ধ্যার পর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হালের ক্রেজ “মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা” গানের সাথে অনেক বন্ধুরা নেচে গেয়ে তারুণ্যের দিনগুলোতে ফিরে গেল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিশাল ডিনার, আতশরাজি ও ফানুস ওড়ানো। এসব চলছে মধ্য রাত অবধি। কেনকিছুতেই যেন কারো কোন ক্লান্তি ছিল না।

সকালে প্রাতরাশের মাধ্যমে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালার শুভ সূচনা হল। বেলা ১০ টায় বসে স্মৃতিচারণ আসর। অনেকে তাদের পুরনো দিনের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেয়। দু’জন নেপালি সহপাঠি তাদের সহধর্মীনিদের নিয়ে করলো স্মৃতিচারণ। তাদের স্মৃতিচারণ থেকে বাদ গেল না এরশাদের রাজত্বকালে আমাদের পাওয়া অযাচিত ছুটির কথাও। হলত্যাগের নির্দেশের মধ্যেও কিভাবে তারা হলে থাকার অনুমতি পেয়েছিল তার সরস বর্ণনাও হল। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও হলজীবনের প্রথম দিনগুলো কিভাবে কেটেছিল তার বর্ণনা দিল রসিয়ে রসিয়ে। এরপর মাৎস্য গবেষনা ইন্সটিটিউটে বিশাল আকৃতির মাছ (৯০কেজি ওজন) দর্শন ও হর্টিকালচার মাঠে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জার্মপ্লাজম কেন্দ্র ভ্রমণ। সবই ছিল পরিকল্পনামাফিক কোথাও তেমন কোন সমস্যা হয়নি। গাড়ি-ঘোড়ার আয়োজন ছিল যথাযথ। এর ফাঁকেই কেউ কেউ স্মৃতি বিজড়িত ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বেড়ানো বা নদে নৌ ভ্রমণও সেরে এসেছে। অনেকে দু’দিনের কোন এক সুযোগে স্মৃতিময় হলের রুম ঘুরে এসেছে। সব সময়ই ছিল একাকী বা দলবেঁধে ছবি তোলার হিড়িক। সবশেষে Raffle draw ও বিদায়ী ভোজ দিয়ে দু’দিন ব্যাপি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে আর বেজে উঠে বিদায়ের করুণ সুর। আবার হবেতো দেখা এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো এ আশায় বুক বেঁধে সবাই যার যার গন্তব্যে পা বাড়িয়েছে।

এ পুনর্মিলনীতে যারা একাকী এসেছিল তারা যেন পুরনো দিনে ফিরে যেতেই ঝাড়া হাত পা হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। যারা পরিবার নিয়ে এসেছিল তারা স্ত্রী সন্তানকে গর্ব ভরে দেখিয়েছে তাদের হল, পাঠস্থান বা আড্ডার স্থল। কারো মুখই মলিন ছিল না। ছিল খুশী ঝলমল। তবে বিদায় বেলায় সবার মনটা আর্দ্র হয়ে যায়।

সার্বিক ব্যবস্থাপনা ছিল সুশৃঙ্খল। এতগুলো লোকের থাকার সুন্দর সুব্যবস্থা ছিল। খাবার দাবারে ছিল না তেমন কোন ত্রুটি। হয়ত কোথাও কারও জন্য কোন ছোট খাট বিচ্যূতি হয়ে থাকতে পারে। তবে সার্বিকভাবে প্রায় নিখুঁত। তবে একট বড় খুঁত ছিল। না আয়োজকদের পক্ষ থেকে নয়। ছিল অংশগ্রহনকারীদের পক্ষ থেকে। কেউ কেউ নাকি আসার কথা বলেও শেষ মুহূর্তে পিছুটান দিয়েছে। সবচেয়ে কম অংশগ্রহণ ছিল ঢাকা থেকে। নানা অজুহাতে অনেকেই পিছিয়ে গেছে। অংশগ্রহণ আরও একটু বেশি হলে হয়ত আরও একটু আনন্দঘন হত। তবু যতটুকু হয়েছে তা কম কিছু নয়। একটি সফল ও সুন্দর পুনর্মিলনী আয়োজনের জন্য আয়োজক কমিটির সকলকে জানাই সাধুবাদ।

(বাকৃবি ‘৮০-‘৮১ ব্যাচের পুনর্মিলনীর নির্মোহ মূল্যায়ণ)
লেখক: মো: রফিকুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ