অর্থবহ নির্বাচন উপহারে নতুন সিইসি’র ‘চ্যালেঞ্জিং’ মিশন
প্রকাশিতঃ 4:56 pm | February 28, 2022

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর :
সতের কোটির বাংলাদেশ তাকিয়ে তাঁর দিকে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপহার দেওয়ার কঠিন এক চ্যালেঞ্জিং মিশনের সূচনা করেছেন। কবির ভাষায়-সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনকেই ভালোবেসেছেন। পুরাতন চিন্তা-ভাবনাকে ভেঙে নতুনকে আহ্বান করা যুগের শৌর্য বীর্য অক্ষয় মনুষ্যত্বই যেন ধারণ করেছেন।
সন্দেহ-অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। চ্যালেঞ্জকে ভয় নয় মোকাবেলা করার বার্তা দিয়েছেন। শপথের অনুগত থেকে দায়িত্ব পালনে নিজের আকাঙ্খার কথা উচ্চারণ করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘মানুষের জীবনই একটা চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনও একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চ্যালেঞ্জকে ভয় পেলে চলবে না। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে আমরা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারব।’
সততা, দক্ষতা ও নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে দেশের সতের কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার বাস্তব প্রতিফলনই ঘটিয়েছেন নতুন এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। তত্ত্ব-তথ্য-প্রজ্ঞা-নির্মোহতায় তাঁর দৃঢ়চেতা বলিষ্ঠ উচ্চারণে আশান্বিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ।
চায়ের স্টল থেকে শুরু করে বিভিন্ন আলোচনার টেবিলে, টিভি টকশোতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চূলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে গণমাধ্যমের সঙ্গে নতুন সিইসি’র স্বকীয় স্বরের আশাবাদী উচ্চারণ। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধশালী করতে প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আগ মুহুর্তে মানবিক মূল্যবোধ, টিম ওয়ার্ক আর সবার আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি বিশাল মাইলস্টোনও স্পর্শ করতে চান নবনিযুক্ত সিইসি।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) নিজ কার্যালয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিক দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে ঠিকঠাক করতে চান কর্মপরিকল্পনা। অধ্যয়ন ও চর্চার আগে বাড়বাড়ন্ত কোন শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেননি। ভোটারদের আস্থা ফেরাতে কী করতে চান এমন প্রশ্নের জবাবের জন্য অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অঙ্গীকার করেছেন নিজেদের সেরা কাজটিই উপহার দেওয়ার।
বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সর্বশেষ জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৪ সালের ২ মার্চ এই মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তারপর একই বছর ১ ডিসেম্বর জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি অবসরে গেলে ২১ জানুয়ারি একই মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবেই পুনর্নিয়োগ পান তিনি। কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সব বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ভূমিকা পালন করেন।
বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। প্রবীণ এই চিকিৎসক শুরু থেকেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সরব ছিলেন। সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে তিনি ৮ জনের যে নাম প্রস্তাব করেছিলেন সেখানেই ছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম। ইতোমধ্যে নতুন এই সিইসিকে মেনে নিতে সব বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আগের দিন শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় নির্বাচনকে সার্বজনীন করতে নিজেদের সর্বাত্নক প্রয়াসের কথা জানিয়েছিলেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বিএনপি’র মতো একটি বৃহৎ দলকে তিনি নির্বাচনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার কথা বলেছিলেন।
সিইসি সেদিন বলেন, ‘বিএনপি জানিয়েছে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেন না। আমাদের চেষ্টা থাকবে বিএনপির মতো একটি বড় দলকেও নির্বাচনে নিয়ে আসা। নির্বাচনকে যদি অর্থবহ করতে হয়, গ্রহণযোগ্য করতে হয়, সার্বজনীন করতে হয়, তাহলে সবার অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তবে সব দল যে আসবে তেমন নয়, তবে বড় দলগুলোর আসা দরকার। সবাইকে আস্থায় নেয়ার চেষ্টা থাকবে নতুন কমিশনের।’
একটি সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের একা কাজ নয় উল্লেখ করে নতুন সিইসি বলেছিলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সবপক্ষে সম্মিলিত ও এক হয়ে কাজ না করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায় না। সবাই মিলে চেষ্টা করলে এবং সবার সহযোগিতা পেলে নতুন কমিশন একটি সুন্দর এবং সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে বলেও মনে করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।
শপথের অনুগত থেকে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার সিইসি’র
রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে শপথ গ্রহণ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সোজা সাপ্টা অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তাঁর কথায় কোন বাগাড়ম্বরতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। টু দ্য পয়েন্টেই উত্তর দিয়েছেন।
অন্যান্য কমিশনাররাদের সঙ্গে নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে বলেছেন, ‘সবার কাছে দোয়া চাই, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সঠিকভাবে, দক্ষতার ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে, শপথের অনুগত থেকে আমরা যেন দায়িত্ব পালন করতে পারি।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সেটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক বা জাতীয় নির্বাচন হোক। আমরা এই চ্যালেঞ্জ এখনও বুঝে উঠিনি। দায়িত্ব নিলে পরে আমরা চারদিকে তাকিয়ে বুঝবো আসলে কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি না। সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সে লক্ষ্যে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলব, কর্মপদ্ধতি গড়ে তুলব এবং আমাদের কৌশল নিরূপণ করব।’
শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধুমাত্র ইসি নির্বাচন করে না। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর সঙ্গে অনেকে জড়িত। সবাই যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়; আমাদের ওপর একটা প্রিন্সিপাল দায়িত্ব আছে, সহযোগিতাগুলো আদায় করে নেওয়া। আমরা আশাবাদী, অত্যন্ত আশাবাদী। আমি যে সহকর্মীদের পেয়েছি, ওনাদের ওপর আমার আস্থা আছে। আশা করি আমার ওপরও ওনাদের আস্থা আছে, আমরা আমাদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রয়াস দেওয়ার চেষ্টা করবো। বাকিটা আল্লাহ পাক জানেন।
নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আপনারা কী করবেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে নতুন সিইসি বলেন, এসব বিষয়ে এখন আমি বেশি কিছু বলবো না। শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) আমি অনেক কিছু বলেছি। নতুন করে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
তিনি বলেন, এরপর আমরা যা কিছু বলবো সমন্বিত ভাবে, আমার যে সহকর্মীরা আছেন তাদের সঙ্গে বসে ঐক্যমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেব। তখন আমরা আরও নির্ভরযোগ্যভাবে কথা বলতে পারব।
সিইসি আরও বলেন, আমাদের ওপর দায়িত্ব আরোপিত হয়ে গেছে। তবে এখনও আমরা বাস্তব দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। সোমবার আমরা কার্যস্থলে যাব। তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করব, ভাবের আদান-প্রদান করব। সংবিধান ও আইনে আমাদের ওপর কী কী দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এ দায়িত্ব কীভাবে পালন করব, সেটা ঠিক এ মুহূর্তে বলতে পারব না। আগামীতে আমরা আরেকটু লেখাপড়া করে, জেনে তারপর আপনাদের বলতে পারব।’
বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা করছে বিএনপি!
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে কিছুদিন আগে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছিল রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটি। সেই আলোচনায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন। সার্চ কমিটির কাছে তিনি যে আট জনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, সেই নামের তালিকায় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নামও ছিল। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল না করলেও রাজনৈতিক মহলে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবেই পরিচিত তিনি।
ব্যক্তিগতভাবে অনেকে তার রাজনৈতিক ভাবনার বিপরীতে অবস্থান করলেও তার ভাল কর্ম-উদ্যোগের প্রশংসা করেন, শ্রদ্ধা জানান। সুশীল সমাজ বিশেষ করে বদিউল আলম মজুমদার, ড. শাহদীন মালিক, আসিফ নজরুলসহ অনেকেই ডা. জাফরুল্লাহকে পছন্দ করেন, শ্রদ্ধা করেন এবং সুশীল সমাজে তার একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে। ফলে রাজনৈতিক সচেতন অনেকেই মনে করছেন, এবারের নির্বাচন কমিশন নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা খুব একটা প্রশ্ন তুলবে না। তবে বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা করার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
বিশেষ করে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইতোমধ্যেই বলেছেন, বর্তমান সিইসি সরকারের সুবিধাভোগী ও অনুগত। এই কমিশন গ্রহণযোগ্য নয়। তারা এই কমিশন মানেন না। তাদের লক্ষ্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন। তাদের এ আচরণকে বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা করা বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল একজন সৎ, মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃত। তিনি তার কর্মজীবনে কখনোই পক্ষপাতের নজির স্থাপন করেননি। তিনি কারো সুবিধাভোগী হিসেবেও চিহ্নিত নন। ফলে মুখে মুখে বিএনপি বিরোধীতা করলেও ভেতরে ভেতরে তারাও খুশি একজন নিরপেক্ষ সিইসি হিসেবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নিয়োগে, এমন গুঞ্জণও ভাসছে চারিদিকে। কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গঠনের প্রথম ধাপ পূরণ হয়েছে। গ্রহণযোগ্য, অর্থবহ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারলে তিনি ঠাঁই করে নিবেন আজ ও আগামীর ইতিহাসের সোনালী পাতায়।

কালের আলো/এএবি/এমএম