সাধারণের মনে মেশার অসাধারণ ক্ষমতা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের

প্রকাশিতঃ 11:11 am | March 03, 2022

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর :

কোন ভনিতা নেই, মনখুলেই কথা বলতে পারেন দেশের ১৩তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাঁর কথায় রয়েছে তীক্ষ্ণ রসবোধের স্পর্শ। সম্ভবত জীবনকে ক্লোজ শটে নয় লং শটেই দেখেন। সাধারণের মনে মেশার অসাধারণ ক্ষমতাও রয়েছে তাঁর।

বাস্তবানুগ কথাবার্তাই বিশ্বাসী বলেই কীনা কাহিনিকাব্যের সূত্রপাত করেন না। সত্যের শক্তিতে পথচলার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। অতীত ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাসে নিজেকে না মুড়িয়ে ইতিবাচক ভবিষ্যতের নিয়ন্তা হতেই উজ্জ্বল থেকেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছেন প্রতিনিয়ত। একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপহার দিতে সব দলের প্রতি সমান আচরণ করার অঙ্গীকার করেছেন। বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার প্রবণতা তৈরি থেকে সরে আসতে বলেছেন। একজন জেলেনস্কি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে সব রাজনৈতিক দল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন। একেবারেই সোজা-সাপ্টা বা স্ট্রেট ফরোয়ার্ড এই সিইসি।

এককভাবে নয় কমিশনের অপর চার সদস্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের কথা জানিয়েছেন। অর্থাৎ, টিম ওয়ার্কই তাঁর এই কঠিনকে জয় করার বার্তা বহন করছে যেন। মঙ্গলবার (০১ মার্চ) অন্য চার কমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার অদূরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবেও একই ইঙ্গিত করেছেন নবনিযুক্ত সিইসি।

তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি, সমঝোতার বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করবে। এই বিষয়ে আমরা কী করব, সেটি সহকর্মীদের সঙ্গে সভা করে, নিজেদের মধ্যে কাজ করে সিদ্ধান্ত নেব। নির্দিষ্টভাবে আমরা কীভাবে এগোবো, সেই বিষয়ে আমাদের আরও চিন্তাভাবনা করতে হবে।’

তেড়েফুঁড়ে কথা বলাটাও যেন ধাঁচে নেই নতুন সিইসি’র। তিনি পুনরুত্থিত করেছেন স্বাধীনভাবেই কাজ করার মন্ত্র। হাস্যরসকভাবেই বলেছেন, ‘রাজনৈতিক বা কোন মহল থেকে চাপের কোন প্রশ্নই নেই। তবে আমার নিজের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে দায়িত্বের চাপ।’

ভোটের দায়িত্ব পালনের সময় অপকর্মকে ক্ষমার অযোগ্য ‘দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রভাব ও প্রলোভনমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে আহ্বান জানিয়েছেন। সবাই মিলে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করার প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ করেছেন।

ভোটার দিবস উপলক্ষে নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে বুধবার (২ মার্চ) আয়োজিত আলোচনা সভায় নিজের নেতৃত্বাধীন ইসির নির্বাচন কমিশনারদের উদ্দেশ্যে এভাবেই কড়া বার্তাই দিয়েছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।

অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে ইতোমধ্যেই জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবেন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে চলার বার্তা
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাঁর প্রতিটি বক্তব্য দারুণভাবে আশাবাদী করে তুলেছে দেশের সচেতন মানুষকে। তাঁর প্রতিটি বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ জাগরণের আভাস মিলেছে।

প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে চলার বার্তা মিলেছে। তিনি নিজেও বলেছেন, ‘ভোটাধিকার রক্ষা করবো, এটা ফাঁকা বুলি নয়। আগামী সংসদ নির্বাচনে মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।’

কালের আলো পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে দেখেছে, ভাষার কচকচানির পরিবর্তে সহজ, আপসহীন-সাহসী উচ্চারণে পারঙ্গম নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। কঠিনকে সাবলীলভাবেই উপস্থাপন করেই মোহাবিষ্ট করতে পারেন সবাইকে।

ভবিষ্যৎদৃষ্টি, দৃঢ়চেতা মনোভাবের সঙ্গে হাস্যরসের সমন্বয় এবং ব্যক্তিকে মনে রাখার অনন্য দিকও রয়েছে তাঁর। দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে উপসংহারে পৌঁছারও বিরল গুণ রয়েছে। নিজের উচ্চ ব্যক্তিত্ববোধের সঙ্গে সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাসের সমন্বয় করতে পারেন। যেকোন কঠিনকে জয় করার যে শক্তি ও সামর্থ্য দরকার সেটিও রয়েছে একজন কাজী হাবিবুল আউয়ালের।

বিশ্লেষকরাও বলছেন, সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা রয়েছে যেকোন চাপ সামাল দেওয়ার। সিইসি তো বটেই অন্যান্য চার কমিশনারও কর্মজীবনে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন। নীতির প্রশ্নে আপোস করেননি।

সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অবলীলায় প্রশাসন চালিয়ে গেছেন। এমন একঝাঁক আলোকিত মুখের সমন্বয়ে গঠিত এই নির্বাচন কমিশন আরও শক্তিশালী, দক্ষ ও নিরপেক্ষ হবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ নির্বাচন উপহার দিতেই সক্ষম হবেন।

চ্যালেঞ্জে মোড়ানো বর্ণাঢ্য অধ্যায়
নিজের রক্তচাপ থাকলেও এই পর্যন্ত কোন চাপের কাছেই মাথা নত করেননি সদ্য নিয়োগ পাওয়া নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। নিজের বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন। অন্যায়, নীতি-নৈতিকতাহীন আবদার-অনুরোধকে ঘৃণাভরেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বিসিএস ১৯৮১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে শুরু করেছিলেন তাঁর চাকরি জীবন। ১৯৯৭ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। অবসরের পর তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কলাম লিখেছেন। নিষ্ঠাবান ও কর্মদক্ষতার কারণে আপন গতিতেই চাকরি করে গেছেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে, জন্ম কুমিল্লায়।

২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত সরকারকে নির্বাচনের পথে নিয়ে আসা, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, বিডিআর হত্যা মামলার তদন্তসহ বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কাজী হাবিবুল আউয়াল কর্মজীবনে সফলতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেন। দেশের স্বার্থে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। কোন প্রকার অন্যায়ের সঙ্গে আপোসের কোন দৃষ্টান্ত নেই।

বিচার বিভাগ থেকে আসা হাবিবুল আউয়াল আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় কিছু লোক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরি নিতে আসেন। কিন্তু তিনি সেটি ধরে ফেলেন এবং অনেক জোরালো তদবির উপেক্ষা করে তাদের নিয়োগ দেননি। এজন্য তিনি অনেকের কূপানলে পড়েন। বলা হয়, ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন প্রধান রূপকার। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হওয়ার পরও বিচার বিভাগের মুখচেনা কর্মকর্তাদের অনৈতিক আবদার উপেক্ষা করেন।

এরপর কাজী হাবিবুল আউয়াল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগ দেন। সেখানেও অনেক প্রভাবশালীর হজ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করে দিয়ে হৈচৈ ফেলে দেন। কানে তুলেননি কোন তদবির। ফলত বিরাগভাজন হয়েছেন অনেকের। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পর জাতীয় সংসদ সচিবালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে থাকার সময়ই সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। অবসরে যাওয়ার ৫ বছর পর দেশের ১৩ তম সিইসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। একেবারেই স্বাধীনচেতা এই মানুষটি পদে পদে নিরপেক্ষতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সিইসি এবং অপর চার কমিশনার নিয়োগ দেন। এ বিষয়ে গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে। সংবিধান অনুসারে পুরো ৫ বছর সময়কালে তাঁরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনা করবেন।

কালের আলো/এসবি/এমএম