সোনালী আঁশ আর ‘গলার ফাঁস’ নয়!

প্রকাশিতঃ 10:27 am | March 10, 2022

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

এমন এক সময় ছিল যখন পাটই ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। রপ্তানি আয়েরও সবচেয়ে বড় উৎস ছিল পাট, যাকে বলা হতো সোনালি আঁশ। রক্তের দামে কেনা লাল-সবুজের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই সোনালি আঁশ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের রক্ত জল করা পরিশ্রমে উপার্জিত সোনালি আঁশ থেকে যে রফতানি আয়, তা চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে।

১৯৬৬’র ছয় দফায় উঠে আসে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রসঙ্গটি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।’ অর্থাৎ আমাদের পাটের আয় আমাদেরই থাকতে হবে। কিন্তু পাটের এই শৌর্যের সূর্য অস্তগামী হয় ক্রমশই। একাত্তরে দেশ স্বাধীনের আগেই পলিথিন চলে আসে বাজারে। সেই পলিথিন দখল করে নিতে থাকে পাটের ব্যাগের বাজার।

কমতে কমতে একসময় বন্ধই হয়ে যায় পাটের ব্যবহার। কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নেন চাষীরাও। কিন্তু এসব এখন পুরনো ধারাপাত। দিনবদল আর পালাবদলে এখন ফিরেছে আবার পাটের জৌলুস। পাট চাষ করে এখন লাভবান হচ্ছেন চাষীরা। করোনা মহামারীর মধ্যেও আগের যে কোন সময়ের তুলনায় পাটের বেশি দাম পেয়েছেন চাষীরা। চলতি বছর বিভিন্ন এলাকায় চাষীরা প্রতিমণ পাট বিকিয়েছেন আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। কোথাও কোথাও মণপ্রতি এই দাম গিয়ে ঠেকেছে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়।

বাজারে ভালো দাম আর চাহিদা বেড়ে যাওয়াই মূলত ইঙ্গিত দিচ্ছে সুদিন ফিরছে এই সোনালী আঁশের। সরকার বন্ধ পাটকলগুলো পুনরায় চালুর পাশাপাশি পাটের বহুমুখি ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সোনালী আঁশের হাত ধরে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনাও জেগে উঠেছে।

জানা যায়, দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের উপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে পাট ও পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। মানুষও পাট পণ্যকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করছে।

সরকারি বন্ধ পাটকলগুলোও চালু হয়েছে। বেসরকারি খাতেও গড়ে উঠছে নতুন পাটকল। দেশে পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে বিদেশে রফতানি। পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

বাংলাদেশে পাট দিয়ে পাট সুতা, দড়ি, বস্তা, প্যাকিং সরঞ্জাম, ব্যাগ বা থলে, হাতে বাছাই করা আঁশ, পাটজাত কাপড় বহুদিন ধরে তৈরি হয়। এখন সেই সঙ্গে পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে। পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, নারী-পুরুষের জুতা স্যান্ডেল, বাস্কেট, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও পাটের তৈরি গৃহস্থালি নানা সরঞ্জামের বিদেশে চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় এই জাতীয় পণ্য রপ্তানি করা হয়। আফ্রিকান দেশগুলো বস্তা ও পাটজাত দড়ি বেশি রপ্তানি হয়। পাটের আঁশের পাশাপাশি পাটখড়িরও একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এসব পণ্য দিয়ে পার্টিকেল বোর্ড, কম্পোজিট, সেলুলয়েডে ব্যবহার হয়।

এই বছর পাটের বীজ বপন ও পরবর্তীতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় পাটের ভাল ফলন হয়েছে এবং পাট সহজেই জাগ দিতে পেরেছেন চাষীরা। তবে উত্তরাঞ্চলের কোন কোন জায়গায় পানি না থাকায় পাটগাছ জাগ দিতে কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছিল চাষীদের। পরবর্তীতে বৃষ্টি হওয়ায় সেই সমস্যা কেটে গেছে। ঠিকমতো পাট কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে শুকিয়ে সেই পাট এখন বাজারে বিক্রির ধুম পড়েছে।

দেশে পাটকল বন্ধ হলেও বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে বাড়ছে রফতানিও। পাশাপাশি পাট দিয়ে এখন বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশেও পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। সব মিলিয়ে পাট নিয়ে এখন আর কৃষকের দুশ্চিন্তা নেই। বরং পাট বিক্রি করে কৃষক এত মুনাফা পাবেন কোনো দিন চিন্তাই করতে পারেননি।

এক সময়ে দেশে যেখানে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়ার জন্য কৃষকের পক্ষ থেকে দাবি উঠত, সেখানে এখন শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়ার দাবি উঠছে। যদিও কাঁচা পাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় খুশি নন বেসরকারী পাটকল মালিকরা। তারা বলছেন, এত বেশি দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। এতে দেশে পাট পণ্যের উৎপাদন কমে যাবে।

পাটের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর। এখানে প্রতিবছরই বাড়ছে পাট চাষ। জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র বলছে, ফরিদপুরের আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য উপযোগী। গত এক বছরে পাটের উৎপাদন বেড়েছে ১০ হাজার ৭৬৩ মেট্রিক টন। তোষা জাতীয় পাট চাষের দিক থেকে ফরিদপুর দেশের শীর্ষে রয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে রাজবাড়ী, পাবনা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, মাদারীপুর, যশোর, মেহেরপুর গোপালগঞ্জ ও ঝিনাইদহ।

আলাপ হয় ফরিদপুরের পূর্ব ভাষাণচর গ্রামের চাষী শাহজাহান মন্ডলের সঙ্গে। গত বছর পর্যন্ত তিনি যে জমিতে ধান চাষ করেছেন এবার সেখানে করেছেন পাট চাষ। এই চাষী জানান, দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছেন পাট। বিক্রি করে ভালো লাভ পেয়েছেন। সামনের দিনগুলোতেও পাট চাষে থিতু হবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই বছর সাড়ে আট লক্ষ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে কম-বেশি ৯০ লাখ বেল (১৮২ কেজিতে এক বেল)। প্রতি বিঘায় গড়ে নয় মণ পাট চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ স্থানে প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকার ওপরে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৭ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছিল। সেই বছর মোট উৎপাদন হয়েছিল ১৫ দশমিক ২৬ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে এই বছর উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশের পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্র বলছে, সারা বিশ্বে এখন প্লাস্টিক বা সিনথেটিক ফাইবার বাদ দিয়ে ন্যাচারাল ফাইবারের একটা ডিমান্ড তৈরি হয়েছে। নানা ধরণের পণ্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে এই খাতে অনেক প্রাইভেট সেক্টর তৈরি হয়েছে, বিনিয়োগ হয়েছে, যারা পাট দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করছে। ফলে এই খাতে একটা প্রতিযোগিতার বাজার তৈরি হয়েছে।

তারা কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে পাট কিনছে। তাই পাটের চাহিদাও বাড়ছে, দামও বেড়েছে। ভালো দাম পাওয়ার কারণে কৃষকরাও পাট চাষের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এক যুগের রেকর্ড ভেঙ্গে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ১১৬.১৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। আগের বছরের তুলনায় গত বছর পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছর সারাদেশে সাত লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৮২ লাখ টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে দেশে এবার আট থেকে সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। আর এই থেকে ৯০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত পাটের আঁশের প্রায় ৫১ শতাংশ পাটকলগুলোয় ব্যবহৃত হয়, ৪৪ শতাংশের মতো কাঁচা পাট বিদেশে রফতানি হয় এবং মাত্র ৫ শতাংশের মতো লাগে ঘর-গৃহস্থালি আর কুটির শিল্পের কাজে।

কালের আলো/এসবি/এমএম