রমজানে নিজেকে কতটা সংযত রেখেছি

প্রকাশিতঃ 10:54 am | April 18, 2022

মাহমুদ আহমদ:

আজ সোমবার। পবিত্র মাহে রমজানের মাগফিরাতের দশকের ষষ্ঠ দিনের রোজা অতিবাহিত করার আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তৌফিক দান করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

পবিত্র মাহে রমজান নিজেকে সংযত রাখার আর বিশেষ ইবাদতের মাস। রমজানের ‘রোজা’ মানুষের মনের পাপপ্রবণতাকে সংযত করে, অসহায়-দরিদ্র ক্ষুধার্তদের কষ্ট ও যন্ত্রণা, ব্যথা ও বেদনা হৃদয় স্পর্শ করতে সাহায্য করে, মানুষকে শিক্ষা দেয় ধৈর্য। কিন্তু আমরা কি আদৌ নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছি? হৃদয়ে দয়ামায়া কমে যাচ্ছে আর প্রতিশোধের প্রবনতা যেন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামান্য কারণে রেগে গিয়ে মারমুখি হয়ে উঠছি। অথচ পবিত্র মাহে রমজান আসে আমাদের সংশোধনের জন্য কিন্তু আমরা থাকি দুনিয়ার মোহে আসক্ত।

পবিত্র মাহে রমজানের কত যে গুরুত্ব তা হয়তো আমরা অনেকে জানিনা। আমরা যদি এর গুরুত্ব বুঝতাম তাহলে হয়তো দুনিয়ার পিছনে ছুটতাম না।

পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে মহানবি (সা.) তার প্রিয় সাহাবিদেরকে বিভিন্ন নসিহত করতেন। একবার নবি করিম (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শোন শোন! তোমাদের কাছে রমজান মাস আগত। এ মাস বরকত মণ্ডিত মাস, যে মাসে রোজা রাখা আল্লাহ তোমাদের জন্য আবশ্যক করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় আর বিদ্রোহী শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এছাড়া এ মাসে এমন একটি বরকতময় রাত আছে, যে রাত হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম, যে এর বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল সে অসফল হলো’ (নিসাঈ, কিতাবুস সওম)।

রমজান এমন এক প্রিয় মাস যে মাসের আগমনে উর্ধ্বলোকেও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় এবং জান্নাত সুসজ্জিত করা হয়। হুজুর পাক (সা.) বলেন, ‘রমজানের শুভাগমন উপলক্ষ্যে সমস্ত বছর জুড়ে জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয়। আর যখন রমজানের আগমন হয় তখন জান্নাত বলে, হে খোদা! এ মাসে তুমি তোমার বিশেষ বান্দাদেরকে আমার জন্য মনোনীত করো’ (বায়হাকি, সা’বুল ইমান)।

মহানবি (সা.) অন্যত্রে বলেন, রমজানের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখো, কেননা এটি আল্লাহতায়ালার মাস যা অতি বরকতমণ্ডিত এবং অতি উচ্চ পর্যায়ের। তিনি তোমাদের জন্য ঐ এগার মাস ছেড়ে দিয়েছেন, যে মাসগুলোতে তোমরা নিশ্চিন্তে পানাহার করে থাকে এবং সকল প্রকার স্বাদ আশ্বাদন করে থাকো কিন্তু তিনি নিজের জন্য একটি মাস মনোনীত করেছে’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ)।

রমজানুল মুবারককে সাইয়্যেদুশ শুহুর অর্থাৎ সকল মাসের সরদারও বলা হয়েছে। এ মাস অগনিত বরকতের মাস। চৌদ্দশত বছর পূর্ব থেকে কোটি কোটি পুণ্যাত্মা এ মাস থেকে বরকত ম-িত হয়ে এসেছে আর বর্তমানেও কোটি কোটি পবিত্রাত্মা এ মাস থেকে লাভবান হচ্ছে। এ দিনগুলোতে নিষ্ঠাবান রোজাদারদের দোয়া কবুলিয়্যতের মর্যাদা লাভ করে। তাদের প্রতি আধ্যাত্মিক নূর বর্ষিত হয়। তারা কাশফ বা দিব্যদর্শন, সত্য স্বপ্ন এমনকি ইলহামের কল্যাণও লাভ করতে সক্ষম হয়।

রমজানের দিনগুলোতে মহানবির (সা.) ইবাদত সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন: রমজানে তিনি (সা.) কোমর বেধে নিতেন এবং পূর্ণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতেন। মহানবির (সা.) ইবাদতের অবস্থার বর্ণনা এভাবেও এসেছে যে, ‘রাতে ইবাদতের সময় তার (সা.) বক্ষ আল্লাহতায়ালার সমীপে কান্নাবনত হতো, হৃদয় বিগলিত হতো এবং বুকের মাঝে এমন কান্নার শব্দ শোনা যেত যেভাবে হাড়িতে পানি টগবগ করলে শব্দ হয়’ (শামায়েলে তিরমিজি)।

রোজা পালনকারী রোজা এবং ইবাতদের কারনে আল্লাহতায়ালাকে লাভ করে। খোদার সাক্ষাৎ এবং খোদার দিদার লাভ হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন: ‘তোমাদের খোদা বলেছেন, প্রত্যেক নেকীর প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত আর রোজার ইবাদত বিশেষ ভাবে আমার জন্য আর আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দিব অথবা আমি স্বয়ং এর প্রতিদান হব’ (তিরমিজি, আবওয়াবুস সাওম)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যখন কেউ রমজানের প্রথম দিন রোজা রাখে তখন তার পূর্বেকার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। এমনিভাবে রমজান মাসের সমস্ত দিন চলতে থাকে এবং প্রতি দিন তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা সকালের নামাজ থেকে শুরু করে তাদের পর্দার অন্তরালে যাবার আগ পর্যন্ত তার ক্ষমার জন্য দোয়া করতে থাকে’ (কানযুল উম্মাল, কিতাবুস সওম)।

একবার মহানবি (সা.) বলেন, ‘ফেরেশতা রোজাদারের জন্য দিন-রাত এস্তেগফার করতে থাকে’ (মাযমাউয যাওয়ায়েদ)। হজরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমানের সাথে সোয়াব এবং এখলাসের সাথে ইবাদাত করে সে নিজ গুনাহ থেকে এভাবে পবিত্র হয়ে যায় যেভাবে সেদিন সে তার মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম লাভ করেছিল।

পবিত্র মাহে রমজানের রোজা জান্নাত লাভের মাধ্যম। এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যদি এক দিনের রোজা নিজ খুশি এবং সন্তুষ্টি এবং মনোযোগী হয়ে রাখে এরপর তাকে যদি পৃথিবী সমান স্বর্ণ দেয়া হয় তবুও তা হিসাবের দিন তার পুণ্যের বরাবর হবে না’ (আততারগিব ওয়াত তারহিব)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘যে বান্দা খোদার পথে এক দিন রোজা রাখে আল্লাহতায়ালা তার চেহারা থেকে আগুনকে দূরে সরিয়ে দেন’ (মুসলিম ও ইবনে মাজা)। অপর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, মহানবী (সা.) বলেনে, ‘খোদার জন্য এক দিনের রোজা পালনকারী থেকে জাহান্নাম শত বছর দূরত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয়’ (নিসাঈ, কিতাবুস সওম)।

পবিত্র রমজান হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগী আর সংযমের মাস। ইতোমধ্যে রহমতের দশক শেষ হয়ে মাগফিরাতের দশকেরও কয়েকটি রোজা অতিবাহিত হয়েছে। এখনও যারা নিজেদের ইবাদতে সেভাবে মগ্ন হোন নি, যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, তাদেরকে বলব, অবশিষ্ট দিনগুলোকে কাজে লাগান। কেননা, এ পবিত্র মাস যে আমার জীবনে পুনরায় আসবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই দিনগুলোতে ইবাতদের গুরুত্ব অনেক বেশি।

তাই আসুন না, আমরা আমাদের পাপসমূহকে ক্ষমা করিয়ে জান্নাতের স্বাদ উপভোগ করি। সেই সাথে সকল প্রকার পাপকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখি এবং গরীব-অসহায়দের সেবায় হাতকে প্রসারিত করি।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট