রমজানের শেষ দশ দিন হোক পবিত্র রজনীর সন্ধান
প্রকাশিতঃ 12:13 pm | April 23, 2022
মুফতি তানজিল আমির :
দেখতে দেখতে চোখের পলকেই যেন ২০টি দিন পেরিয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো নাজাতের দশক। পবিত্র এ মাস শুরু হওয়ার পরও অনেকে জীবনের গতিপথ বদলায়নি, ভেবেছিল কয়েক দিন পর আমলের হিসাব কিতাব শুরু করবো, মাত্র তো রমজান শুরু! কিন্তু হায়, চোখের পলকেই যেন ২০টি রোজা চলে গেলো।
রমজানের বাকি সময়টুকু আমাদের হিসাব করে কাটাতে হবে। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রমজান পেলো, অথচ নিজের গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারলো না। প্রিয় নবীজির এ বদদোয়ার ভাগীদার যেন না হতে হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে।
সিয়াম সাধনা প্রকৃত অর্থেই একটি ভালোবাসা-জাগানিয়া প্রকল্পের নাম। আল্লাহর জন্য এ ভালোবাসায় বান্দার ইমান পরিপূর্ণ হয়। পরিপক্বতা আসে।
সিয়াম বা রোজা হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা, শালীনতা, উন্নত নৈতিকতা, আত্মার সজীবতা ও চিন্তার বিশুদ্ধতা অর্জনের এক বলিষ্ঠ মাধ্যম।
ভেতর থেকে বদলে যাওয়ার সাধনা। তাই তো রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন– ‘সিয়ামরত অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশালীন ও অর্থহীন কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়।
কেউ যদি তাকে অশালীন কথা বলে কিংবা তার সঙ্গে অকারণে বাদানুবাদে লিপ্ত হতে চায়, তবে সে যেন এ কথা বলে দেয়, আমি রোজাদার।’ (বুখারি)।
রমজানের এই শেষ দশ দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের অফুরন্ত রহমত ও ক্ষমার ঘোষণা রয়েছে এ সময়টিতে। রাখা হয়েছে হাজার বছরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী ‘লাইলাতুল কদর’। আল্লাহতায়ালা চান, তার প্রিয় বান্দা এ দশ দিন পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেবে প্রভুর প্রেমে। লাইলাতুল কদরকে এ কারণেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যেন বান্দা পবিত্র এ রজনীর তালাশে কাটিয়ে দেয় পুরো দশটি দিন।
নবীজি (সা.) এই সময়টাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। আমলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। ইতিকাফ করে লাইলাতুল কদর বা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ও মূল্যবান রজনী অনুসন্ধান করতেন।
রোজার শুরু থেকে আমাদের যেসব অপূর্ণতা এবং আমলের ঘাটতি এতদিনে হয়ে গেছে, তা এখন পুষিয়ে নেওয়া দরকার। গাফিলতি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এখনই আল্লাহমুখী হওয়া খুব জরুরি।
রমজানের অবশিষ্ট দিনগুলোতে কয়েকটা আমল আমাদের বিশেষভাবে করতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শেষ দশকের আমলগুলো হলো এই-
লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান: ইরশাদ হয়েছে, তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করো। (সহিহ বুখারি)
লাইলাতুল কদর অর্থ সম্মানিত রজনী বা ভাগ্য নির্ধারণের রজনী। এই রাত হাজার মাসের চেয়ে মর্যাদাবান এবং এই রাতে পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত করা হয় বলে এই রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়।
রাসুল (সা.)-এ রাত অনুসন্ধান করতেন এবং উম্মতকেও অনুসন্ধান করতে বলেছেন। কারণ, কদরের রজনীর নির্দিষ্ট বর্ণনা কোরআন ও হাদিসে নেই। তবে আবু হানিফার মতে ২৭তম রাত। কিন্তু এ মতের ওপর নির্ভর করে বসে না থাকাই ভালো।
সাদাকাতুল ফিতর: অর্থাৎ দানের মাধ্যমে ভঙ্গ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন দান ও ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করা হয়, তাই এই দান সাদাকাতুল ফিতর এবং এই দিনকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।
ধনী স্বাধীন মুসলমান ব্যক্তির ওপর সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) সাদাকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক ও অশালীন বাক্যালাপ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং নিঃস্বদের খাদ্যদানের জন্য। (সুনানে আবি দাউদ)
রাসুল (সা.) রমজানে অধিক পরিমাণে দান করতেন। তিনি রমজান মাসকে শারুল মুয়াসাত তথা সহানুভূতির মাস বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ইতিকাফ করা: আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইবাদতের উদ্দেশ্যে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ রমজানের শেষ দশকের বিশেষ আমল। কেবল মনিবের সন্তুষ্টির জন্য একান্তে বসে ইবাদত বন্দেগি করা উচ্চ মানসম্পন্ন মুমিনের পরিচয়।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ওফাত পর্যন্ত এমনটা করেছেন। তবে যে বছর তাঁকে তুলে নেওয়া হয়, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন।
রাত জেগে ইবাদত: হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন। ইবাদতের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন। পরিবারের সবাই যেন ইবাদতে রাত কাটায় সেদিকে লক্ষ রাখতেন।
তাই রমজানের এ শেষ সময়ে আমাদের দৃঢ়সংকল্প করতে হবে যে, আমরা রমজানের অফুরন্ত কল্যাণ থেকে অবশ্যই উপকৃত হবো। বাকি আর যে কয়টি দিন আছে, একটি মুহূর্তও অবহেলায় নষ্ট করবো না। পবিত্র এ মাসে গুনাহমুক্ত জীবন গড়ার শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক প্রশিক্ষণ কাজে লাগাব।
আল্লাহর দুয়ার আজ থেকে অবারিত, প্রশস্ত, ক্ষমার জন্য উন্মুক্ত। আসুন প্রভুর দুয়ারে, বসে যাই ইস্তেগফার, তাহাজ্জুদ, তাসবিহ, সদাকাহ, তেলাওয়াত আর প্রার্থনায়। মিলে যেতে পারে ক্ষমা, সৌভাগ্যের ‘লাইলাতুল কদর’।
লেখক: ধর্ম বিষয়ক গবেষক