দুর্নীতিতে ডুবন্ত সাবেক এমপি আউয়াল হতে চান জেলা পরিষদের প্রশাসক!

প্রকাশিতঃ 11:12 pm | April 25, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

একেএমএ আউয়াল। পিরোজপুর-১ আসনের দু’বারের সংসদ সদস্য। ওই সময়ে সময়ে গোটা এলাকায় কায়েম করেছিলেন ত্রাসের রাজত্ব। দুর্নীতির মাধ্যমে রকেট গতিতে ঘুরিয়েছেন নিজের ভাগ্যের চাকা। নিজের সহোদর ছোট ভাই মেয়র হাবিবুর রহমানও তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমপি সাব টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না।’ টাকার নেশায় নষ্ট হয়েছিল ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত রেকর্ড দুর্নীতি আর নানান অপকর্মে নিজে ডুবেছেন, দলকেও ডুবাতে চেয়েছিলেন আউয়াল।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। বিভিন্ন দুর্নীতি ও তথ্য গোপনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৯ ও ২০২০ সালে মোট ৫টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। তন্মধ্যে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুটি এবং ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আরও তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। জাল-জালিয়াতির অভিযোগে তিনটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। নিজের ও স্ত্রীর স্থাবর অস্থাবর সবসম্পত্তি আদালতে নির্দেশে জব্দও করেছে সংস্থাটি।

একেবারেই তলানিতে থাকা ভাবমূর্তি ফেরাতে এবার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছেন একেএমএ আউয়াল। প্রশাসক পদে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আসছেন, এই খবরে নতুন মতবলব পেয়ে বসেছে তাকে। নিজে হতে চাচ্ছেন পিরোজপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক। এ নিয়ে না কী উচ্চ পর্যায়ে নানা চেষ্টা-তদবিরও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর গুণধর চ্যালা চামুন্ডারা বলাবলি করছেন ‘সামনে আসছে সুদিন, আউয়াল ভাইকে জেলা পরিষদে চেয়ার দিন।’

তবে দুর্নীতিবাজ সাবেক সংসদ সদস্যের এমন তৎপরতায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে আউয়ালকে বসানো হলে সরকারের ইমেজ সঙ্কটে পড়বে। দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্নীতির মামলা চলমান রয়েছে এমন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুন্য সহিষ্ণুতা নীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সরকারের বিষয়ে স্থানীয় এমনকি দেশের মানুষের কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা যাবে। যেটি ঘনিয়ে আসা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

অবশ্য জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে আসতে নিজের অনাপত্তির কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়াল। বলেছেন, ‘জেলা পরিষদ নিয়ে আমি খুব বেশি আগ্রহী না। দ্বাদশ সংসদের ভোটেই আমি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এরপরও যার দল করি সে যদি দায়িত্ব দেয় তাহলে তো কিছু করার নেই।’

দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কোন জনপ্রতিনিধির দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির আগে স্থানীয় সরকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর আগে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এমনটি হলে মানুষের কাছে নেতিবাচক এক বার্তা যাবে।’

আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ পুরো পরিবার
শুধু সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়ালই নন, তাঁর ছোট ভাই স্থানীয় সদর পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকের বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির মামলায়। দু’ভাইয়ে মিলে দুদকের মামলার সংখ্যা সাত। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সাবেক সাংসদের স্ত্রী লায়লা পারভীন ও মেয়র পত্নী নীলা রহমানের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে দুদকের।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক আলী আকবর জানান, ‘সাবেক সংসদ সদস্য ও তাঁর ভাই পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে সাতটি মামলার মধ্যে তিনটি মামলার চার্জশিট জমা হয়েছে আদালতে। বাকি চারটি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই এসব মামলার চার্জশিটও জমা দেওয়া হবে।’

দুদক সূত্র জানায়, একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা তিনটি মামলারই চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার বিচারকার্য চলছে। আদালত আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আর পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক ও তার স্ত্রী নীলা রহমানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। পৌর মেয়র মালেক ও তার স্ত্রী নীলা রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক।

দুদক সূত্র জানায়, পিরোজপুরের সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়ালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি ও তথ্য গোপনের দায়ে ২০১৯ ও ২০২০ সালে একে একে ৫টি মামলা করে দুদক। এরমধ্যে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুটি এবং ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আরও তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।

জাল-জালিয়াতির অভিযোগে তিনটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। তদন্ত সূত্র বলছে, সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়াল ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি খাস জমি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে বন্দোবস্ত দেখিয়েছেন। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা সদরে ভিটি বন্দোবস্ত মামলার মাধ্যমে ৭ ব্যক্তির নামে একসনা বন্দোবস্ত পান।

দুদকের তদন্তে ওই নামের কোনও লিজ গ্রহীতাকে পাওয়া যায়নি। সরকারের ওই খাস জমি দখল করে রেখেছিলেন খোদ সাবেক এমপি আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীন। এমনকি খাসজমি বন্দোবস্ত নেওয়ার নিয়মনীতির ব্যত্যয় করে স্ত্রীর নামে নির্মাণ করেছেন দ্বিতল ভবনও।

দুদক সূত্র জানায়, সরকারি খাস জমি দখল ছাড়াও তার বিরুদ্ধে জেলার অতি পরিচিত ‘রাজার পুকুর’ ভরাট করতে অবৈধভাবে প্রাচীর নির্মাণের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এছাড়া নেছারাবাদ উপজেলায় কয়েকটি মৌজায় বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি দখলের অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এসব জমিতে তিনি নিজ নামে আউয়াল ফাউন্ডেশনের কার্যালয় নির্মাণ করে দখলে রাখেন।

দুদক সূত্র জানায়, সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুটি মামলার তদন্ত একেবারেই শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কমিশনের অনুমোদন নিয়ে যেকোনও সময় এই দুই মামলার চার্জশিটও আদালতে জমা দেওয়া হবে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫৫ টাকার সম্পদ
দুদক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ জারির পাশাপাশি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে তার নামে অবৈধ উপায়ে অর্জিত এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫৫ টাকা মূল্যের সম্পদের মালিকানার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে মোট ১৫ কোটি ৭২ লাখ ৪ হাজার ৮৪৩ টাকার সম্পদ গোপন করার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, মামলার তদন্ত শেষে আউয়ালের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ও তার স্ত্রীর নামে প্রায় ১০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য সন্নিবেশিত করে চার্জশিট তৈরি করা হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে যেকোনও সময় আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়াল বলেন, ‘আমি সরকারের খাস জমি একসনা লিজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলাম। এজন্যই আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। আর আয়কর নথির বাইরে আমার কোনও সম্পত্তি নেই। তৃতীয় কোনও পক্ষ আমার বিরুদ্ধে এগুলো করাচ্ছে।’

দুর্নীতিতে কম যান না মেয়র ও স্ত্রী
সাবেক এমপি আউয়ালের ভাই স্থানীয় সদর পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক। দুদক জানিয়েছে, গত বছরের ১৮ মার্চ মালেক ও তার স্ত্রী নীলা রহমানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে একটি মামলায় মালেক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৯৩২ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিস্তারিত অনুসন্ধানে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

আরেকটি মামলায় পরস্পর যোগসাজশে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে ঘুষের বিনিময়ে পৌরসভায় ২৫ জন কর্মচারীকে নিয়োগের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই মামলায় নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরাসহ মোট ২৮ জনকে আসামি করা হয়।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার বিষয়েও তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এই দুই মামলারও চার্জশিট তৈরি করা হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে যেকোনও সময় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।

যোগাযোগ করা হলে পিরোজপুর পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নিজেকে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বলে দাবি করে বলেছেন, ‘প্রতিপক্ষ কেউ আমার বিরুদ্ধে দুদককে দিয়ে মামলা করিয়েছে। আমার সম্পদ বিবরণীতে যা আছে, সবই আয়কর ফাইলে আছে। আর আমার স্ত্রীর নামে কোনও সম্পদও নেই।’

দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘একেএমএ আউয়াল পরিবারের জামিন কেন বাতিল হবে না তা নিয়ে ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন। শিগগিরই জামিন বাতিলের চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। তবে তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনের ৪০৯ ধারাসহ অনেক অভিযোগে মামলা চলছে। মামলায় তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ মিলেছে।’

কালের আলো/ডিএস/এমএম