মিয়ানমারে মুসলিম নিধনের শেষ কোথায়?
প্রকাশিতঃ 12:48 am | October 05, 2017
এহসান রফিক: মিয়ানমার সরকার উত্তর আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিম নিধনযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছে। সেখানে তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে নিবির্চারে গণহত্যা করছে। অন্তঃসত্ত্বা নারীকে গণধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, হত্যা নিপীড়নসহ রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। গত আগস্টের শেষ দিকে শুরু হওয়া এ হত্যাযজ্ঞ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে ভিডিওচিত্রসহ উঠে এসেছে। প্রতিবদনে বলা হয়েছে, বিভৎস মৃত্যুর মহোৎসব থেকে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী হয়েছেন বাংলাদেশে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, এ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আরো বিপলু সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্ত ও পাশের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন। এছাড়া গণহত্যার শিকার হয়ে রাখাইনে গত দু’সপ্তাহে নিহত হয়েছেন অন্তত তিন হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের সেই লোমহর্ষক ও ভয়াবহ চিত্র তাদের মুখের বর্ণনাসহ দেশী-বিদেশি গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে চাল কিনতে সচিবসহ মিয়ানমারে যান বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের সঙ্গে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে। এর সমালোচনা করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার সীমান্তে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়ে সরকার- বাংলাদেশকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। এদিকে রাখাইনে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলেও বিশ^নেতারা এখন পর্যন্ত কার্যত কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালদ্বীপ ছাড়া মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা স্রোত সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোসহ বিশ^বাসীকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক হত্যা-নিপীড়ন
গত ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাত থেকে ২৫ আগস্ট শুক্রবার ভোর পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সেনাঘাঁটিতে ‘জঙ্গিদের’ সমন্বিত হামলায় কমপক্ষে ৮৯ জন নিহত হয়। এই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য নিহত হয়েছে বলে দাবি করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ‘দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’ এই হামলার দায় স্বীকার করে। সচেতন বিশ্ববাসীর মূল রহস্য বুঝতে মোটেও দেরি হয়নি। এ ঘটনার পর থেকেই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে এ জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকরা। এতে নির্বিচারে নিরীহ রোহিঙ্গা নাগরিকদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বিশ্ব গণমাধ্যমগুলো বলছে, এ পর্যন্ত ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর জীবন বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। যার সংখ্যা এরই মধ্যে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মিয়ানমার সরকার সন্ত্রাসীদের পরিচয় দিতে গিয়ে সরকারি বিবৃতিতে মুসলিমদের পরিবর্তে ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। এই শব্দে চক্রান্ত ও গভীর ষড়যন্ত্রের নতুন সূত্র পাচ্ছেন রাজনৈতিক বোদ্ধামহল। জানা গেছে, এই হামলার আগের রাতে সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে একটা মিটিংয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয় যে, রাখাইনে একজন রোহিঙ্গার চিহ্নও থাকতে পারবে না। হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগের ধরন দেখে মনে হচ্ছে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে তাদের খুব একটা বেশি সময় লাগবে না। রোহিঙ্গাদের প্রায় সকলেই তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে জঙ্গল, পাহাড় ও নদী অতিক্রম করে অতি কষ্টে বাংলাদেশে ঢুকেছে-ঢুকছে। শরনার্থী রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই করুণ।
মানবাধিকার লঙ্ঘন
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভিযানকালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড ও বৌদ্ধ যুবকরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের ওপর যৌন সহিংসতা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর থেকে রাখাইনের মংডু জেলার অন্তত নয়টি গ্রামে নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ, গণধর্ষণ, আগ্রাসী দেহ তল্লাশি ও যৌন হামলার ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড ও স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকরা এসব অভিযানে অংশ নেয় বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ১৮ জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এইচআরডব্লিউর গবেষকেরা। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তাদের মধ্যে ১১ জনই রাখাইনে যৌন হামলার শিকার হওয়ার কথা জানান। ১৭ জন নারী ও পুরুষ তাদের কাছের স্বজনদেরকে যৌন সহিংসতার শিকার হতে দেখেছেন। ওই ১৭ জনের মধ্যে আবার যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া কয়েকজন নারীও রয়েছেন। সব মিলিয়ে সংগঠনটি ২৮টি ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। ‘সন্তান প্রসবের মাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে ধর্ষণ করা হয়। আমার তখন নয় মাস চলছিল। তারা জানত আমি গর্ভবতী, কিন্তু তাতেও দমেনি তারা,’ ছোট্ট একটি কন্যা শিশুকে কোলে নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিনিধিকে কথাগুলো বলছিলেন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী আয়মার বাগন। গতবছর নতুন করে শুরু হওয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় ধর্ষণের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা নারীরা যে নতুন সামাজিক সমস্যায় পড়েছেন- এই বক্তব্য সেদিকেই ইঙ্গিত করে। সেনা অভিযানের সময় পুরুষশূন্য হয়ে পড়া গ্রামগুলোতে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের অনেককেই পরিত্যাগ করেছেন তাদের স্বামীরা। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিনিধির বরাতে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রোহিঙ্গা নারীদের এমন দুর্দশার চিত্র। সরকারি লোকজনের চোখ এড়িয়ে ধর্ষণের শিকার এসব রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলেন এএফপির ওই প্রতিনিধি। আয়মার বাগন নামে মুসলিম রোহিঙ্গা নারী ওই সাংবাদিককে বলেছেন, সেনাসদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর তিনি স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে গিয়েছেন। রাখাইনের কায়ার গং টং নামে একটি গ্রামের বাসিন্দা ২০ বছর বয়সী আয়মার এখন অন্যের সাহায্যে জীবন-ধারণে বাধ্য হয়েছেন।
৮০ বছরের মাকে কাঁধে নিয়ে ৬৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পৌঁছান জাফর। চার পাশে শুধুই গোলাগুলি আর ভারি অস্ত্রের গগণবিদারি গর্জন। যতদূর দেখা যায়, ততদূর শুধু আগুনের লেলিহান শিখা আর আকাশ অন্ধকার করা কালো ধোঁয়া। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ আর নির্যাতন থেকে বাঁচতে যে যেদিকে পারছে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার গ্রামের জাফর আলমের বাড়িতে অসুস্থ মা। কী করবেন, কোথায় যাবেন, সেটাই তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। কোনো উপায় না দেখে সব সহায় সম্পদ ফেলে মা আছিয়া খাতুনকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন জাফর। প্রাণের ভয়ে কয়েক দিন রাখাইন রাজ্যের এদিক ওদিক ছুটে একপর্যায়ে অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ পান জাফর। অবশেষে বাংলাদেশে পৌঁছান তিনি। তাদের ঠাঁই হয় উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। জাফরের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। নিজের মাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে আসার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা জানান জাফর আলম। তার মায়ের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারেন না খুব একটা। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে জাফর বলেন, আঁকা-বাঁকা পথ, বেশির ভাগ এলাকায় যানবাহন নেই। যতটুকু রাস্তায় যানবাহন চলাচল করত, তাও এখন বন্ধ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও পথে পথে চেকপোস্ট। এ কারণে বিকল্প পথ হিসেবে পাহাড়-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। এজন্য সময় লেগেছে পাঁচদিন।’ জাফর বলেন, ‘এতদিনের এই দৌড়ঝাঁপের কারণে আমার মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনাহারে অর্ধাহারে কোনো মতে নো-ম্যানসল্যান্ডে পৌঁছেছি। আমাদের আপাতত ঠিকানা হয়েছে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের বস্তিতে। সব মিলিয়ে আমার মায়ের অবস্থা ভালো না। নিজেকে নিয়ে নয়- মাকে নিয়ে আমি খুব চিন্তায় আছি।’ এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা জানিয়েছেন, গত ২৫ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। প্রতিদিন গড়ে ২০ করে রোহিঙ্গা মুসলিম শরনার্থী বাংলাদেশে ঢুকছে। তবে অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, পালিয়ে আসা শরণার্থীর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী- তাও বলতে পারছেন না কেউ। বাসস্থান, খাবার, বস্ত্র ও চিকিৎসার অভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী হয়ে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গাদের জীবনও এখন চরম মানবিক বিপর্যায়ের মুখে।
আন্তর্জাতিক চক্রান্ত
মিয়ানমারের মানবিক সংকটের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটিতে সফর করেছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত সহিংসতার কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ও মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচি এক যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সমস্যাকে ‘সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের বিতর্কিত কূটনীতির পেছনে তাদের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রেজিজু স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, রোহিঙ্গারা নিবন্ধিত হোক বা না হোক, আইন অনুযায়ী তারা এ দেশে অবৈধ অভিবাসী। ভারত থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হবে।’ ভারতীয় সরকারের তথ্যমতে, দেশটিতে বর্তমানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। চীন বাংলাদেশেরও বন্ধুপ্রতিম দেশ। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের নীতিকে বাংলাদেশ কতটা প্রভাবিত করতে পারবে? এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আমেনা মহসিন মনে করেন, চীন এমন একটি রাষ্ট্র যারা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। মিয়ানমারের সাথে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতির জন্য মিয়ানমারকে প্রয়োজন। তাই রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবার বিষয়টিকে চীন সমর্থন করবে বলে মনে হয় না। ফিলিস্তিনের মুসলমানদের মতোই হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজ মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানরা। ফিলিস্তিনিরা যেমন ইহুদিবাদী ইসরাইলের আক্রমণের মুখে স্বদেশ ছেড়ে পাশের দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তেমনি রোহিঙ্গারাও মিয়ানমারের থাবায় বাংলাদেশসহ নানা দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মুসলিম নিধনে মিয়ানমারের সাথে হাত মিলিয়েছে ভারত ও ইসরাইল। এক সময়ের স্বাধীন আরাকান রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গারা মাতৃভূমিতে আজ তারা সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হয়েছেন। অবশেষে ফিলিস্তিনি ও রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিষয়ে ইসরাইল এবং মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের নীতির মিল থাকার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানোর জন্য যেসব সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে তা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করেছে ইসরাইল। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ চালানোর জন্য অভিযুক্ত মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিবাদী অবৈধ রাষ্ট্রটি। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডলইস্ট আই ও ইসরাইলি দৈনিক হারেজের প্রতিবেদনে ইসরাইল এবং মিয়ানমারের এ আঁতাতের তথ্য প্রকাশিত হয়।
বিশ্বনেতাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক টুইট বার্তায় বলেন, মিয়ানমারের জাতিগত নির্মূল অভিযান বন্ধ করতে চাইলে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এরদোগানের ফোনের জবাবে সুচি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার নিরাপদে রেখেছে। রাখাইনকে সুরক্ষিত করছে মিয়ানমার সরকার। ব্রিটিশের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন সুচির উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিন। আপনার দুর্দিনে আমরা আপনার প্রতি সদয় ছিলাম। আমরা রাজপথে আপনার জন্য মিছিল-মিটিং করেছি। পেছনের কথা ভুলে যাবেন না।’ বৃটিশের ১৫৭ জন এমপি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মালদ্বীপ -মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংসতার প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকেও মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে রাশিয়ার চেচনিয়াতেও বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের মালালা বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অবৈধ হলে শতাব্দিব্যাপী কীভাবে সেখানে তারা রয়েছে? রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মমতার চিত্র দেখে আমার হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। বাংলাদেশি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে দেয়া খোলা চিঠিতে রাখাইনে দ্রুত মানবিক বিপর্যয় বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনি গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিন।’ আর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে মিয়ানমার পরিস্থিতির জন্য দায়সারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বক্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ- স্রেফ দায় এড়ানো ছাড়া কিছুই নয়। আর রাশিয়া তো মুখে ক্লুব এটেই রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বলছে, রাখাইন প্রদেশে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে “কুরুখ” নামের ক্ষুদ্র এক নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন শুরু করেন। যার মধ্য থেকে ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন। বঙ্গোপসাগরের এই উপকূলীয় রাখাইন অঞ্চলে আসতে থাকেন পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরব ও পাঠানরা। এ সকল সম্মিলিত নৃগোষ্ঠী আজকের রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। রোহিঙ্গারা হল আরাকান বা রাখাইনের সবচেয়ে পুরোনো ভূমিপুত্র। তাদের আগে রাখাইনে কোন জনবসতি ছিলো না। অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকান রাজ্য ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়। নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্য ‘রোহাঙ’ নামে পরিচিত ছিল, সেই অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবেই রোহাঙ থেকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের উদ্ভব হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহাঙ্গা বা আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। এ সময়ে ১৬ জন মুসলিম রাজা আরাকান শাসন করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করে চরম বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু করেন। এরপর আরাকান রাজ্যটি ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার আগে মিয়ানমারের ১৩৯টি ক্ষুদ্র নৃজাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করলেও চক্রান্তমূলক বাদ দেয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে। ব্রিটিশের সেই চক্রান্ত ও ভুলের মাসুল আজও গুনে চলেছে নিরপরাধ রোহিঙ্গা মুসলমানরা।
সংঘাতের শুরু
১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ্য দখলদার কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা “আনাওহতা” বার্মা থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করেন। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস। তার একটি (দক্ষিণে) বার্মার বংশোদ্ভুত ‘মগ’ আর (উত্তরে) ভারতীয় বংশোদ্ভুত ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের বিরুদ্ধে দস্যুবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। মোগলরা তাদের তাড়া করে বার্মার জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। মগের মুল্লুক কথাটি সেখান থেকেই এসেছে। আর উত্তরের ভারতীয় বংশোদ্ভুত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। তারা শান্ত প্রকৃতির বলে ইতিহাস সাক্ষী দেয়। তারা মগদের থেকেও পুরানো বাসিন্দা। এটাও ইতিহাসের স্বীকৃতি। বৃটিশ থেকে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জীবনে শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে এই জনগোষ্ঠির নাগরিকত্ব বাতিল করে। এতে শত শত বছর ধরে রাজ্যটিতে বাস করা রোহিঙ্গারা নানাবিধ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
যুগে যুগে রোহিঙ্গা নির্যাতন
রোহিঙ্গাদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইসলাম ও ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মার পূর্ণ নাগরিক ছিলেন। সেই বছর সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ষড়যন্ত্র স্বরুপ একটি নতুন আইন পাশ করে। সেখানে দেখানো হয় যে, ১৮২৪ সালে ব্রিটিশরা বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে বসবাসকারি রোহিঙ্গাদের বার্মায় নিয়ে আসে। ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়। বার্মা থেকে আগত রোহিঙ্গারা জানায়, তাদের বার্মায় বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। এছাড়া হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের স্বীকার হতে হয় নিত্য নৈমিত্তিক। রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য করায় সে দেশের সরকার। ১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। বার্মার শাসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখনও এটা ছিল একটি মৃত্যুপূরী। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারীতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলমান ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জনে উন্নিত হয়।
আত্মরক্ষার চেষ্টা
১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ, মায়ানমারের মিনবিয়া এবং ম্রক-ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। এই দাঙ্গায় উপ-কমিশনার ইউ য়ু কিয়াও খায়াং নিহত হন। যিনি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বার্মা আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ব্যাপকহারে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এতে বহু রোহিঙ্গা মুসলমান প্রাণ হারায়। ১৯৪৭ সালে রোহিঙ্গারা মুজাহিদ পার্টি গঠন করে। যারা জিহাদি আন্দোলন সমর্থন করতো। মুজাহিদ পার্টির লক্ষ্য ছিল আরাকানে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মুজাহিদ পার্টি জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। নে উইন তাদেরকে দমনের জন্য দুই দশকব্যাপী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। উল্লেখযোগ্য একটি অভিযান ছিল “কিং ড্রাগন অপারেশন” যা ১৯৭৮ সালেও পরিচালিত হয়। এর ফলে অনেক মুসলমান প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং শরণার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যার রোহিঙ্গারা ভারত ও পাকিস্তানে চলে যায়। এরপর দিনদিন রোহিঙ্গারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় “বিশ্বের সবচেয়ে অন্যতম নিগৃহীত ভাগ্যবঞ্চিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী।
অধিকার বঞ্চিত জনগোষ্ঠি
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং পারেনা দুইটির বেশি সন্তান নিতে। যতরকম বঞ্চনা আছে তার সবই তাদের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিকৃষ্ট জাতের মানুষ মনে করে। তারা সরকারী চাকুরী করতে পারে না, সরকারী কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। এজন্য প্রায় ৯০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত। প্রায়ই মায়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারী জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বাংলাসাহিত্যে আরাকানের অবদান
আরাকান রাজ দরবারে অনেক বাঙালি মুসলমান কাজ করতেন । বাংলাদেশের সাথে আরাকানের গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল । এ কথা সত্য, ভারতবর্ষের বহু বাঙালি, মোগল, পর্তুগিজ, আভা, বার্মা, মঘী, বড়ুয়া, আফগানি, সিন্ধি, হিন্দু, তিব্বতীয়, মঙ্গোলীয়, আর্য ও অনার্য রক্তের বহমান ধারায় বার্মার আরাকান রাজ্য সুবিস্থৃতি লাভ করেছিলো। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং বা আরাকন রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি আরাকানে বসে লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না, লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক বদিউজ্জামান ও জঙ্গনামার মতো প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলা সাহিত্যচর্চার তীর্থভূমি আরাকানের রোসাঙ রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চা যদি না হতো, যদি মাগন ঠাকুর, আলাওলরা সেখানে বসে সাহিত্য চর্চা না করতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ রকম নাও হতে পারতো। রোসাঙ্গ বা আরাকানের রাজভাষা ফার্সী থাকলেও সেখানে বাংলা ভাষা রাজসভায় সমাদৃত ছিল।
এমন সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্য থাকার পরও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইন মুসলিমদের কার্যত কোনও বন্ধু নেই! বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় তাদের সাময়িক আশ্রয় হলেও কোথাও নেই নাগরিকত্ব। নেই শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অন্যের দয়ায় এভাবে কতদিন টিকে থাকতে পারবেন রোহিঙ্গা নামের ইতিহাসের চরম নির্যাতিত নৃজাতিগোষ্ঠীটি এখন প্রতিনিয়ত সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশে^র প্রতিটি বিবেবকান মানুষের মাথায়।