বিশ্বনবির অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষা
প্রকাশিতঃ 10:25 am | June 12, 2022
মাহমুদ আহমদ :
বিশ্বনবি ও খাতামান্নাবেঈন হজরত মুহাম্মদ (সা.) যাকে সাদা-কালো, ধনি-গরিব সবার ত্রাণকর্তা হিসেবে আল্লাহতায়ালা প্রেরণ করেছেন, তার বিরুদ্ধে কেউ যদি বিকৃতভাবে কিছু উপস্থাপন করে সেক্ষেত্রে তাকে উন্মাদ বলা ছাড়া আর কী-বা বলা যেতে পারে। কেননা এই উন্মাদদের এমন হীন আচরণে বিশ্বনবির সম্মানে কি সামান্যতম ঘাটতি দেখা দেবে? অবশ্যই না, বরং এতে মুসলিম উম্মাহ মহানবির (সা.) অতুলনীয় জীবনাদর্শ সবার কাছে আরও ভালো করে তুলে ধরার চেষ্টা করবে।
যেই মহান রাসুলের জন্য আল্লাহতায়ালা এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার সম্মানের ওপর আঘাত হানবে এমন সাহস কি কারও আছে? বিধর্মীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন কিন্তু শ্রেষ্ঠনবির সন্মানে এক চুল পরিমাণও ব্যাঘাত ঘটবে না, কারণ এই মহান নবির সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা যেখানে এই সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন যে, ‘ওয়া ইন্নাকা লা আলা খুলুকিন আজীম’ অর্থাৎ নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত’ (সুরা কলম: আয়াত ৪)।
তাই যারা এমন গর্হিত কাজে জড়িত তারা ইসলামের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বরং তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেখা উচিত, মহানবি (সা.) কে যারা কটাক্ষ করার চেষ্টা করে এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তারা কোন পর্যায়ের ব্যক্তি। আমরা যদি ক্ষতিয়ে দেখি তাহলে দেখব এই ধরনের লোকদের কোনো ধর্ম নেই এবং তাদের চরিত্রও ঠিক নেই। কেননা কোন ভালো চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি, সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন তারা এমন কাজ করতে পারে না।
কারও কথায় কি ইসলাম কলঙ্কিত হয়ে যাবে? মহানবি (সা.)-এর সম্মানের হানি হবে? অবশ্যই তা কখনো হতে পারে না। কেননা ইসলামই কেবল একমাত্র পরিপূর্ণ ধর্ম। তবে আমরা এধরনের গর্হিত কাজের তীব্র নিন্দা জানাই এবং আল্লাহপাকের দরবারে তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করি। যখন কেউ ইসলামের অবমাননা, কোরআনের অবমাননা এবং রাসুলের (সা.) অবমাননা করবে এর প্রতিবাদ আমরা অবশ্যই করব। তবে আমাদের প্রতিবাদের ধরন হবে শ্রেষ্ঠনবির অনুপম আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে। কোনো দেশের পতাকা পুড়িয়ে বা কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা চালিয়ে বা হত্যা করে অথবা অগ্নিসংযোগ ও অপহরণ করে এর প্রতিবাদ আমরা করব না। কারণ এগুলোর কোনোটাই ইসলাম আমাদের অনুমতি দেয় না।
আমাদের প্রতিবাদের ধরন হবে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য, কোরআনের অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষা এবং বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর অতুলনীয় আদর্শ সারা বিশ্বের মাঝে ফুটিয়ে তোলা। প্রতিটি দেশে বড় বড় সভা-সেমিনার করা, কোরআন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা এবং সব ধর্মের লোকদের ডেকে ইসলামের শান্তির শিক্ষা সম্পর্কে অবগত করা। এ কাজের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রথমে প্রয়োজন তাহলো সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আজ সারা বিশ্বের মুসলমানদের যদি এক ঐশী নেতা থাকত তাহলে এধরনের গর্হিত কাজের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না।
আমরা যদি প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসলামের আদর্শ ভুলে জুলুম-নির্যাতনের রাস্তা অবলম্বন করি তাহলে বিধর্মীরা এটা বলতে আরও সাহস পাবে যে, মুসলমানরা সন্ত্রাসী আর এরাই পৃথিবীতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। নাউজুবিল্লাহ। তাই বিধর্মীদের কোনোভাবেই অভিযোগের সুযোগ দেওয়া আমাদের মোটেও ঠিক হবে না। আমরা যদি প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেশের রাস্তা বন্ধ করে রেখে জনগণের কষ্ট দেই তা কিন্তু শ্রেষ্ঠ নবির আদর্শের বিপরীত হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে যখন কোনো বিষয়ে অভিযোগ হানা হয় তখন প্রতিটি মুসলমানের হৃদয় কাঁদে এবং ব্যথা পায় আর এটাই স্বাভাবিক।
আজ যারা বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি (সা.) সম্পর্কে কটাক্ষ করে তারা কি এটা জানে না যে, মহানবি (সা.) তো শুধু ইসলামের অনুসারীদের নবি নন, তিনি তো সারা বিশ্বের সব জাতি এবং সব ধর্মের নবি। আর আল্লাহতায়ালা এই মহান নবিকে সমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তি ও রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। এই নবির আগমন বার্তা সব নবিরাই (আ.) দিয়ে গেছেন এবং অন্য নবিরা এই নবির উম্মত হওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করেছেন।
আজ সেই মহান রাসুলকে নিয়ে কটাক্ষ করা হচ্ছে। অথচ অজ্ঞতার যুগের পশুতুল্য মানুষকে ফেরেশতায় রূপান্তর করেছিলেন বিশ্বনবি (সা.)। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে মানুষ যখন সমাজ তাদের নিজস্ব পরিচয় মনুষত্ব হারিয়ে ইচ্ছামাফিক ও স্বেচ্ছাচারী জীবন নিয়ে মত্ত ছিল ঠিক তখনই কোরাইশ বংশের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরব জাহান তথা বিশ্ব মানবকূলের জন্য প্রেরণ করেন শান্তির বাণী দিয়ে হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)কে। জন্মলগ্ন থেকে যাঁর উছিলায় শান্তির সপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বময় রহমত আসতে থাকে। কতই না চমৎকার তার আদর্শ, বিশ্বস্ততা, একনিষ্ঠতা, সত্য, ন্যায় এবং ইসলামের শান্তির কথা বলে, কোটি কোটি হৃদয়কে আকর্ষিত করেছিলেন। সমাজে তার (সা.) লড়াই ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াই আর এ লড়াই ছিল ভালোবাসার মাধ্যমে।
তিনি (সা.) প্রকৃত ইসলামী দর্শন, কোরআন মাফিক বিশাল এলাকা গড়ে তুলতে শাসক হিসেবে, যোদ্ধা হিসেবে, সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ দৃষ্টান্ত তার উম্মতের জন্য রেখে গেছেন। তিনি (সা.) সমাজে কোন ধরনের অশান্তির লেশমাত্র রেখে যাননি। অন্ধকার সমাজ ছিল, যেখানে কোনো আলো দেখা যেত না, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশটির বুকে আলো জ্বালিয়ে দেখিয়েছেন ইসলাম আসলেই যে শান্তির ও কল্যাণের ধর্ম।
তিনি (সা.) শুধু একটি সুন্দর সমাজই প্রতিষ্ঠা করেননি বরং প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা কি? ইসলাম পালন করলে কি লাভ এবং ইসলাম পৃথিবীতে কেন এসেছে এসব কিছুই তিনি (সা.) তার কর্ম দ্বারা শিখিয়ে গেছেন।
ইসলাম প্রকৃতই যে জীবনের সব ক্ষেত্রে শান্তির নিশ্চয়তা দেয় তা-ও তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ইসলামের গৌরবজনক ইতিহাস, অনুশাসন, ঐতিহ্যবাহী জীবন ব্যবস্থায় নারীর মূল্যায়ন। পুরুষসহ সব মানুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন ও প্রেক্ষিত এবং সমাধান দেখে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই ঈমান এনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। সবাই এ কথাও বলতে বাধ্য হয়েছিল, ইসলামই একমাত্র শান্তির ধর্ম হতে পারে। তাই সবাই ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবেই গ্রহণ করেছে।
এই শান্তির ধর্মে কোন ধরনের বল প্রয়োগের শিক্ষা নেই। ইসলাম কাউকে হত্যা করার শিক্ষা দেয় না। কাউকে হত্যার ব্যাপারে বিশ্বনবি (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা করা হবে তা হবে রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত’ (বোখারি)। কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে, শুধু নিষেধ করেই শেষ করেনি বরং যারা এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যক্রম করে তাদের শাস্তি কত ভয়াবহ সে সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। ইসলামের শিক্ষা কত উন্নত যে বল প্রয়োগ করে ইসলামের প্রচার করতে পর্যন্ত বারণ করা হয়েছে।
এত উন্নত শিক্ষা ইসলামের থাকা সত্ত্বেও আজ গুটিকতক উন্মাদরা ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অভিযোগ করে যে, ইসলাম নাকি সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয়। নাউজুবিল্লাহ। অথচ ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সব সময় সোচ্চার। ইসলাম ও মহানবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই কতই না উন্নত শিক্ষা ছিল আমাদের নবি করীম (সা.)-এর। আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছে কিন্তু তিনি পাল্টা প্রতিশোধ না নিয়ে করেছেন ক্ষমা। শত্রুদের জন্য দু’হাত তুলে তাদের সংশোধনের জন্য দোয়া করেছেন।
আমরা দেখতে পাই কেউ কেউ এমনও আছেন যারা মহানবির জিহাদের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি ইসলামের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। হ্যাঁ, মহানবি (সা.) জিহাদ করেছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি তা কেন করেছেন তাও বুঝতে হবে। তিনি কি কোন লোভে বা রাজত্ব দখলের আশায় জিহাদ বা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন?
একটু ভেবে দেখুন! যার জন্য এই জগৎ সৃষ্টি, যিনি সব জগতের জন্য রহমতস্বরূপ হয়ে এসেছেন। আর সেই মহান নবিকে মক্কা নগরীতে ক্রমাগতভাবে ১৩টি বছর কিনা জুলুম অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। মহানবি (সা.) তো ছিলেন নিষ্পাপ ও ন্যায়পরায়ণ, যার কোনো দোষ-ত্রুটি নেই, আর সেই নবিকে (সা.) কতই না অত্যাচার করা হলো, নির্দোষ সাহাবিদেরও তারা ছাড়লেন না।
এসব নজীরবিহীন নিষ্ঠুর জুলুম, অত্যাচার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য তারা মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মদিনায়ও শত্রুরা তাদের স্বস্থিতে থাকতে দিল না। কাফেরদের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ধারণ তা মূলত মুসলমানরা বাধ্য হয়েছিলন সেদিন অস্ত্র হাতে নিতে। মহানবির (সা.) জিহাদ ছিল তাদের বিরুদ্ধে, যারা ধর্মকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেদিন জিহাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহতায়ালার একত্ব বা তৌহিদকে প্রতিষ্ঠা করা। মুসলমানদের অস্ত্র হাতে নেওয়া কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কখনই ছিল না। মুসলমানরা কেবল আত্মরক্ষার্থেই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হয়েছিল। মুসলমানরা নিজেদের পক্ষ থেকে কখনও প্রথমে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। মুসলমানদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে-যেমন ২২ নম্বর সুরার ৪০ আয়াত, ৪ নম্বর সুরার ৭৫ আয়াত, ২২ নম্বর সুরার ৩৯ আয়াত। এসব আয়াতগুলো পাঠ করলেই বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হবে মুসলমানরা কেন জিহাদ করেছিলেন।
আবারো বলতে চাই, মহানবির (সা.) সময়ের জিহাদের লক্ষ্য ছিল আত্মরক্ষা করা, ইসলামকে রক্ষা করা। এছাড়া তখন অস্ত্র হাতে নেওয়ার এটাও উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা, অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোকে যথা মঠ, মন্দির, আশ্রম, শিনাগগ, গির্জা প্রভৃতিকে রক্ষা করা। কোন ধর্মের উপাসনালয়কে ধ্বংস করার কোনো নির্দেশ তিনি (সা.) কখনো দেননি।
মুসলমানদের যুদ্ধ অনুমতি কেবল তখনই দেওয়া হয়েছিল যখন বিরোধী শক্তি তাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। আর এ যুদ্ধ সে সময় পর্যন্ত চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। যে পর্যন্ত না ধর্মের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলেই যুদ্ধ থামিয়ে দিতে বলা হয়েছে। এজন্যই মহানবি (সা.) অনেকগুলো সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। আল্লাহতায়ালার নির্দেশ যদি এমন হতো যে, অবিশ্বাসীরা ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, তা হলে মহানবি (সা.) কখনই ওইসব সন্ধি স্থাপন করতেন না।
আসলে ইসলাম কখনো তরবারির জোরে বিস্তার লাভ করেনি। তরবারির জোরে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম হতে পারে, শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মূলত মহানবি (সা.) তরবারি দিয়ে মানব হৃদয়ের পাপ কালিমা সাফ করেছেন। তরবারির মাধ্যমে তিনি একজনকেও ইসলামের ছায়াতলে আনেননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অমুসলমানরা তরবারির ভয়ে সেদিন কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি বরং শ্রেষ্ঠনবির উন্নত আদর্শের ফলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। হায়! বিধর্মীরা যদি এই শান্তির ধর্মের বিরোধিতা না করে শান্তির ছায়াতোলে আশ্রয় নিতো তাহলে কতই না উত্তম হতো।
শ্রেষ্ঠনবির উম্মত হিসেবে আমরা যেন প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠনবির আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করতে পারি, সেই তৌফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন, আমিন।