‘সুশীল’দের ট্রল সংস্কৃতি নাকি বিকৃতি?

প্রকাশিতঃ 11:26 am | July 30, 2022

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকীন :

ফেসবুকে একদল সুশীল আছেন। তারা নিজেদের অতি উচ্চমার্গের ইন্টেলেকচুয়াল মনে করেন। মনে করেন তারাই শিল্প-সংস্কৃতির বোদ্ধা। তারা আশা করেন, সব শ্রোতা-দর্শক তাদের পছন্দ- অপছন্দের সাথে সহমত জানাবেন। নিজেদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ, শিক্ষা এবং রুচির ভিন্নতার কারণে তাদের ভালো লাগা-মন্দ লাগা ভিন্নরকম হতে পারবে না। ‘কান’ যে নাক, চোখের মতো শরীরের কোনও অঙ্গ না, এটা যাদের জানার কথা না, তারাও কেন রেহানা মরিয়াম নূর সিনেমা কিংবা আজমেরি হক বাঁধনের প্রশংসায় মাতে না!

কেন একটি চ্যানেলের মালিক প্রতি ঈদে গান গাইবেন নিজের চ্যানেলে? কেন হিরো আলমের এত জনপ্রিয়তা একটা শ্রেণির কাছে? কেন ভুলভাল ইংরেজি আর দুর্বল উচ্চারণ নিয়ে নিজের সিনেমায় নায়ক-নায়িকা হবেন কেউ? সমালোচনা আমরা করতেই পারি। কারও কনটেন্টে অশ্লীলতার উপাদান থাকলে তার নিন্দা করতে পারি। সবচেয়ে বড় কথা, দেখা-না দেখার পুরো স্বাধীনতা তো আপনার রিমোটে, কি-বোর্ডে। আপনার বিবেচনায় নিম্নমানের কিংবা সিনেমা ভালো না হলে টিকিট কেটে আপনি দেখতে যাবেন না। কিন্তু এই যে আপনার মতো সুশীল মহামূল্যবান সময় এই অখাদ্য জিনিস নিয়ে অপচয় করছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে?

বাজারে ভালো জিনিস থাকবে, নিম্নমানেরও থাকবে। যার যেমন সামর্থ্য কিংবা রুচি, বেছে নেবে। আপনারাই তো মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলেন। তাহলে হিরো আলমকে নিয়ে আপনাদের এত জ্বালা কেন? তার একটা বিপুল দর্শক-ভক্তকুল আছে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির। তারা আনন্দ পেলে তার কন্টেন্ট দেখবেই। আপনাদের অহমিকা কেন এতে আহত হয়? হিরো আলম যে শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের-ই কি আপনারা আসলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন না? কিন্তু এই অশিক্ষিত, নিম্নমার্গের মানুষরা শিক্ষিত সুশীলদের মতো দেশের ততটা ক্ষতি করে না। বালিশকাণ্ডসহ বিশাল বিশাল দুর্নীতি কিন্তু হিরো আলম কিংবা তার দর্শকশ্রেণির কেউ করে না। করে আর্টফিল্মের দর্শকশ্রেণিভুক্ত শিক্ষিত সুশীল মানুষরা। তবে হিরো আলমের কনটেন্টের অশ্লীল ভাষা কিংবা বডি ল্যাঙ্গুয়েজকে আমিও সমর্থন করছি না। আবার ওর কনটেন্টের অশ্লীলতার উপাদানের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার, তাদের দ্বিচারিতাও মেনে নিতে পারি না। সেদিন দেখলাম, হিরো আলমের কনটেন্ট অন্তর্জাল থেকে সরিয়ে দিতে একজন মামলা করেছেন। এটা নাকি সমাজকে কলুষিত করছে।

একটি চ্যানেলের মালিক তার নিজের চ্যানেলে গান করেন। এতে হাসি পায় অনেকের। কিন্তু টিকা-টিপ্পনির মাত্রা অনেক ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ওই চ্যানেলটির মালিক স্যাটেলাইট টিভি এনেছেন শুরুর দিকে। অনেক শিল্পী সেখানে পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছেন। এখনকার মতো এত এত চ্যানেল তো তখন ছিল না। তো গানের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজের চ্যানেলে বছরে দু-একবার যদি নিজেকে শিল্পী হিসেবে হাজির করেন, এটা তার নিজের ওপর ছেড়ে দেই না কেন?

আমার ভালো লাগে না, আমি দেখবো না। কিন্তু তাকে নিয়ে নির্মম ট্রল করার উদ্দেশ্যে সেই গান দেখা ও শোনার এই মনোবৃত্তির মধ্যে আমি বিকৃতি দেখি।

অনন্ত জলিল একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। কোভিড অতিমারির মধ্যেও আমাদের অর্থনীতির জীবনরেখা চালু রাখা পোশাকশিল্পের বড়সড় প্রতিষ্ঠান চালান। মালিক হিসেবে মানবিক গুণাবলির কথাও শোনা যায়। সফল ব্যবসায়ী অনন্ত সিনেমা বানানো শুরু করেছেন নায়ক হওয়ার জন্য। নায়িকা বর্ষাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। এবং কোনও স্ক্যান্ডাল ছাড়াই অনেক বছর দুজনে সংসার করছেন। ব্যবসার ফাঁকে স্বামী-স্ত্রী নায়ক-নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছেন। দুর্বল ইংরেজি ডায়ালগ দিচ্ছেন। উচ্চারণেও দুর্বল। গল্প, নির্মাণ, কারিগরি দিক দুর্বল। তাই হাসাহাসি হতেই পারে। কিন্তু দিন-দ্য ডে নিয়ে এবারও সুশীল দর্শকদের ট্রল মাত্রাছাড়া। যদিও আমি এবার ছবির কারিগরি দিক নিয়ে বেশ কিছু পজিটিভ রিভিউ দেখলাম।

এবার ঈদে দিন-দ্য ডে-সহ তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এবং যতদূর জানলাম তিনটি ছবিই ভালো ব্যবসা করেছে। প্রচারণার মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু এবার প্রচারণার মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চোখে লেগেছে। চলচ্চিত্রের শিল্পীরা বিভক্ত হয়েছেন। পক্ষ নিয়েছেন। দীর্ঘদিনের সংসারী জুটি অনন্ত-বর্ষাকে অনেকটা নিঃসঙ্গ মনে হয়েছে শিল্পী সমাজের মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, সুশীল শ্রেণি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে জড়িয়ে গেছেন। তারা সুশীল বাক্যবাণে অনন্ত-বর্ষাকে ধুয়ে দিচ্ছেন। চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে পক্ষ নিয়েছেন বুঝে কিংবা না বুঝে।

সুশীল বোদ্ধাদের এত তৎপরতা খুব একটা গায়ে মাখছেন না দর্শকরা। তারা নিজেদের রুচি মতো নিজেদের বিনোদন খুঁজে নিচ্ছেন। বিনোদিত হচ্ছেন, কারণ সবাই তো আর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের খবর রাখেন না। ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছেন নিজেদের পছন্দের তারকাদের।

কাউকে কাউকে বলতে শুনলাম, অনন্ত-বর্ষা ছবি বানাক। শুধু নিজেরা অভিনয় না করুক। দারুণ তো! অনন্ত জলিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী চলচ্চিত্রের বাইরে। তিনি হয়তো সিনেমা বানান সিনেমার নায়ক হওয়ার বাসনা থেকে। বর্ষাকে নায়িকা বানানো হয়তো প্রেমিকা ও স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে। আপনার পছন্দ না হলে দেখবেন না। হিরো আলম তো আপনাদের কাছে রীতিমতো অচ্ছুত সমাজের মানুষ। কিন্তু ওদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ যেন বিকৃতির পর্যায়ে না যায়। প্রতিটা মানুষের কিন্তু সম্মান পাওয়ার কথা।

জানি এই লেখা পড়ে আমার প্রতিও অনেকে বিদ্রূপ-বাণ ছুড়বেন। কিন্তু আমি বিশ্বাসের জায়গা থেকে বলছি। হিরো আলম, অনন্ত-বর্ষার মধ্যে আমি একটা সংগ্রামী রূপ দেখতে পাই। এত বিদ্রুপ-অপমানের মধ্যেও তারা হাল না ছেড়ে শিল্পের প্রতি তাদের আগ্রহ ধরে রেখেছেন। প্রতিভার ঘাটতি থাকতে পারে, তবে ভালোবাসাটা তো আছে। তাদের এই আগ্রহকে আমি সম্মান জানাই।

লেখক: অধ্যাপক, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট