পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, অর্বাচীনদের খিস্তিখেউর ও ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র

প্রকাশিতঃ 9:55 pm | August 20, 2022

মজিবুর রহমান, সহকারী সম্পাদক, কালের আলো:

একজন দক্ষ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভুরি ভুরি সাফল্য রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেনের। অন্য দশজন রাজনীতিক নেতার মতো তিনি কথা বলেন না। তিনি কথা বলেন নিজের স্টাইলে। একেবারে সোজা সাপ্টা। যুক্তি দিয়েই নিজের মতামত উপস্থাপন করেন। উদার, চিন্তাশীল ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর বক্তব্য। কিন্তু গত ক’দিন যাবত বাংলাদেশ-ভারতের স্থিতিশীলতার প্রঙ্গটি পরিস্কার করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেনের একটি বক্তব্যে তোলপাড় চলছে। গণমাধ্যমে স্পষ্ট করা লেখা হয়েছে- ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে।’

বক্তব্যের সামনের বা পেছনের অংশ না টেনে শুধুমাত্র একটি বাক্যকে ঘিরেই ঘটে চলেছে তুলকালাম কান্ড। অনলাইনে, অফলাইনে বা রাজনীতির মঞ্চে একজন আপাদমস্তক বিনয়ী ও সজ্জন মন্ত্রীকে ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবারই কীনা ভাবখানা এমন-মোমেন সাহেব আওয়ামী লীগকে শেষ করে দিয়েছেন। আদতে যুক্তিতর্ক দিয়ে যারা উপসংহারে পৌঁছতে না পারেন তারাই মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন। একজন বলেই ফেলেছেন, ড.মোমেন আওয়ামী লীগের কেউ না!

ক’দিন আগে ৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ওই লাশগুলো তো পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কত স্লোগান! বঙ্গবন্ধু তুমি আছো যেখানে, আমরা আছি সেখানে— অনেক স্লোগান তো ছিল। কোথায় ছিল সেই মানুষগুলো? একটি মানুষও ছিল না, সাহস করে এগিয়ে আসার? একটি মানুষ ছিল না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেনি? এত বড় সংগঠন, এত সমর্থক। এত লোক। কেউ তো একটা কথা বলার সাহস পায়নি।’ দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য গভীরভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কাদা ছোড়াছুঁড়ি না করে নিজেদের সম্মিলিত প্রয়াসকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

ড.মোমেনের একটি বক্তব্যে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই জাত গেলো, জাত গেলো শ্রেণির সঙ্গে যেন একই সুরে কথা বলছেন নিজেদের ভেতরকার কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার রীতিমতো তাকে অস্বীকারই করেছেন! অর্থাৎ পরিস্থিতিকে রীতিমতো উসকে দিয়ে ড.মোমেনকে টার্গেট করে বিপদে ফেলতে গিয়ে প্রকারান্তরে তারা সরকারকেই কী সাইজ করতে চাচ্ছেন, এমন প্রশ্নও উচ্চারিত হচ্ছে রাজনীতির অন্দরে-বাইরে। অতিকথন তত্ত্বে এবার নিজেরাও সস্তায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। একটি উদ্ভুত পরিস্থিতির কিনারা না করে, তাঁর পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো তাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিচ্ছেন? মূলত এর আড়ালে ভিন্ন কোন মতলব রয়েছে কীনা সে প্রশ্নে না গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। শুরু থেকেই দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আবেগ, ভালোবাসা, ভাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আগ্রাসন। বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ঘাঁটি করতো। অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা প্রশিক্ষণ নিতো এবং যার ফলে ভারতের আসাম-ত্রিপুরা-দার্জিলিংসহ বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ধানা বেঁধে উঠেছিল।

বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাংলাদেশের মাটি কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসীদেরকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আর এটিকে তিনি কেবল ঘোষণাই হিসেবে দেননি এটিকে তিনি কার্যকর করে গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল। সেই সময়ে বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বিশেষ করে ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনার পর এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শেখ হাসিনা সেটি বন্ধ করেছেন।

মূলত এসব বিষয়ে ভারতের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েই অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও স্থিতিশীল রাখতে তিনি ভারতের সহযোগিতা বা সমর্থন চেয়েছেন। আর এতেই তিনি কীভাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিলেন এটিই এখন মিলিয়ন ডলার ওজনের প্রশ্ন হয়ে ঠেকেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগেই প্রতীয়মান হবে-দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রশ্নে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি নিজের গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসার নির্যাস থেকেই তিনি এমন কথা প্রসঙ্গক্রমে সম্ভবত বলেছেন। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের গভীরতা বুঝাতে বক্তব্যের অন্তর্গত ভাব ধরতে অক্ষমরাই তার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। কোথায় কী বলতে হবে অবশ্যই সেটি মন্ত্রী বুঝেন এবং জানেন। সারল্যের প্রকাশের সঙ্গে তিনি কখনও অন্যকে ছোট করে দেখেন না। কিন্তু সেই তাকেই এখন রাজনৈতিক অপকৌশলের মাধ্যমে চাপানউতোর স্টাইলে হেনস্থা করা হচ্ছে।

ভুল বুঝাবুঝি এড়ানোর জন্য চট্টগ্রামের মাটিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটি আমরা পুনরায় উপস্থাপন করছি-‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’

‘আমার দেশে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমার দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না, আপনার দেশেও যেমন দুষ্ট লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে আপনাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা কিছু কথা বলেছিলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এ ধরনের প্রটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরো সোচ্চার হয়ে আরো বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হবে। আমাদের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হবে।’

‘আমরা উভয়ে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডকে কখনো প্রশ্রয় দেব না। এটা যদি আমরা করতে পারি, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের মঙ্গল। শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। ২৮ লাখ লোক আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর ভারতে বেড়াতে যায়। ভারতের কয়েক লাখ লোক আমাদের দেশে কাজ করে। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের সুন্দর অবস্থানের কারণে। সুতরাং আমরা উভয়ে এমনভাবে কাজ করব যাতে কোনো ধরনের উসকানিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। ভারত সরকারকে বলেছি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে যদি আমরা উভয়ে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেই।’

একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, ৭১ এবং ৭৫’র খুনিরা বরাবরই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী নগ্ন প্রচারণায় ব্যস্ত। স্বাধীনতার পর থেকেই এই অপতৎপরতা দৃশ্যমান রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের কথাটিও সর্বজনবিদিত। এই সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ভারতকে নিরাপদ করতে একজন শেখ হাসিনার অবদান গোটা ভারতবর্ষই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। ক’দিন আগে আসামের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও উচ্চকন্ঠে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির কারণে ভারতের মাটিতেও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর ফলে ভারতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি চলমান রয়েছে।’

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেন নিজের বক্তব্যে এই বিষয়সমূহ তুলে ধরেছেন। তিনি ভারতের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে শেখ হাসিনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দেশটির তাবড় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বয়ানে উপস্থাপন করেছেন। ভারতের নীতি নির্ধারকরাও এসব কারণে শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ বিষয়টিকে খোলাসা করেছেন।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার বিষয়টিকে মন্ত্রী ড. মোমেন ফোকাস করলেও দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিন্নভাবে। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ড.মোমেনকে ঘৃণ্য কায়দায় হেনস্থার অপপ্রয়াস চালানোর সব আয়োজনই সম্পন্ন করেছেন। কার পারপাস সার্ভ করতে তারা অর্বাচীনের মতোই খিস্তিখেউর করছেন সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখার জোর দাবি উঠেছে জনেজনে।

ড.মোমেন মিডিয়ার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলেন। তিনি নিজেও বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই মিডিয়া তিলকে তাল হিসেবে উপস্থাপন করছে। অর্থাৎ বক্তব্যকে কোন কোন সময় টুইস্ট করা হচ্ছে। বক্তব্যের আগে-পেছনের বিষয়বস্তু তুলে না ধরে নিজেদের সুবিধামতো কাট-পেস্ট করে একজন সম্মানিত মন্ত্রীর গায়ে কলঙ্ক কালিমা লেপনের মাধ্যমে ৭১ ও ৭৫’র খুনিরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণ্য উল্লাসের অবগাহনে নিজেদের পাকপ্রেমকে নতুন কায়দায় মঞ্চস্থ করছে। ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় আমাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’ প্রধানমন্ত্রী এটিও বলেছেন, ‘যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদেরকে আমি জানি, তাদেরকে আমি ভালো করেই চিনি।’

সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রভাবশালী দেশ মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অযাচিত বিতর্ক তৈরি করে একটা আবহ তৈরি করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।

এটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের একটি অংশ বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিমা দেশগুলো এই নীলনকশায় যুক্ত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন রাখঢাক না করেই তাদের বিষয়েও বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন, সমালোচনা করেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তিনি এই বিষয়গুলোর সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন। যাতে করে জনগণ বিভ্রান্ত না হয়। ফলত তাকেই অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের মূল লক্ষ্যবস্তু করা হবে এটি অস্বাভাবিক হিসেবে আমাদের কাছে ঠেকছে না মোটেও।

কালের আলো/ডিএস/এমএম