অবৈধ গ্যাস সংযোগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায় তিতাস
প্রকাশিতঃ 11:07 am | August 23, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
প্রতি বছরই লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ কেটে দেয় দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (তিতাস)। করে জেল-জরিমানাও। কিন্তু পুনরায় সুযোগ বুঝে নেওয়া হয় অবৈধ সংযোগ। আবার সংযোগ কাটে তিতাস। ফের নেওয়া হয় অবৈধ সংযোগ। চিত্র ছিল অনেকটাই এরকম। কিন্তু দিন বদলেছে।
এবার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এই বছরের জানুয়ারি থেকে আদাজল খেয়েই মাঠে নেমেছে তিতাস। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। সঙ্গে মামলা এবং জরিমানা থাকছেই। যেকোনভাবে অবৈধ গ্যাস সংযোগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায় তারা। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই অভিযানে এসেছে দৃশ্যমান সফলতাও।
দিন কয়েক আগে সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। ফেসবুকে নিজের আইডিতে দেওয়া পোস্টের মাধ্যমে অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্য জানিয়ে তিনি সহায়তার অনুরোধ জানান। এ সময় প্রতিমন্ত্রী জানান, ‘চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস। মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই বছরের প্রথম ৬ মাসে ১৬৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে তিতাস। তন্মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৯৯টি এবং তিতাসের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ৬৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। ৫৭১টি স্থানে এসব অভিযান পরিচালনা করে পাইপলাইন ও অনুমোদনহীন চুলা অপসারণ করা হয়।
এসব অভিযানে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি বকেয়া আদায়ও করা হয়। চলতি বছরেই ২ লাখ ২৩ হাজার ৩২৯টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি ২২০ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার অবৈধ লাইনও অপসারণ করে তিতাস। এই সময়ে শিল্পে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২৯৩টি। এগুলোর মধ্যে অবৈধ ব্যবহারের দায়ে ১৮০টি এবং বকেয়ার কারণে ১১৩টির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্যাস চুরি অভিযোগে ইতোমধ্যেই তিতাস নিজেদের ১২ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দিয়েছে।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ নিজেদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা জানিয়েছেন। স্পষ্টভাবে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্ত এবং আমাদের অবস্থান পরিস্কার। যতক্ষণ অবৈধ গ্যাস সংযোগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে না পারব ততক্ষণ অভিযান চলবে।’ একই সঙ্গে বকেয়া আদায়েও নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা জানান এমডি।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজরে গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে ছয় ডলারের গ্যাস এখন ৪০ ডলার হয়ে গেছে। চলমান তীব্র গ্যাস সংকটে গ্যাস চুরি বন্ধ করা গেলে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি অনেক কমে যাবে। আমরা ৪০ শতাংশ সিস্টেম লস থেকে ৭ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে এসেছি। ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ ব্যবহারের দায়ে অন্তত ১৮০টি কলকারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।’
তিতাস সূত্র বলছে, সরাসরি মন্ত্রণালয় থেকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে। প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অবৈধ লাইন অপসারণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জ্বালানি বিভাগ মনে করে, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি গ্যাস চুরি হয়। তাই জোনভিত্তিক মিটারও বসানো হয়েছে। কোনো এলাকার অবৈধ সংযোগ অপসারণের পর ওই এলাকার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিশেষভাবে নজরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
সূত্র জানায়, সাধারণ মানুষের পাইপলাইনের গ্যাসের সুবিধা পাওয়ার আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিলে অবৈধ গ্যাস সংযোগের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে। এই সিন্ডিকেট এতোই শক্তিশালী অতীতে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে অবৈধ গ্যাস সংযোগও দিয়েছে। এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারদলীয় নেতাকর্মী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকাল প্রশাসনের কেউ কেউ সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
তিতাসের হিসাবে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি নারায়ণগঞ্জে। এখানে অবৈধ ১০৭ দশমিক ৯২ কিলোমিটর পাইপলাইন এবং ৯১ হাজার ৮৬৪টি চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে। গাজীপুর এলাকায় ৯১ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন ও ৪২ হাজার ৭২২টি বার্নার উচ্ছেদ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ডিভিশনে প্রায় ১০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন ও প্রায় ১০ হাজার অবৈধ চুলা এবং ঢাকা উত্তরে প্রায় ১১ কিলোমিটার পাইপলাইন ও ৭৭ হাজার ৬৪৪টি অবৈধ চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকায় এক হাজার ৪০৯টি অবৈধ চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে এক গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিতাস গ্যাস ট্রন্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তিতাসের চোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে বহিস্কার করা হবে, কোন রকম ছাড় দেওয়া হবে না।’ মূলত এমডির এই ঘোষণার পর অবৈধ গ্যাস সংযোগের সিন্ডিকেট আর হালে পানি পায়নি। বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয়ে গঠিত একটি কমিটি আছে। সেই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের তিনজন উপসচিবকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে বিভিন্ন অভিযানে পাঠানো হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করে এসে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেসব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অধিকাংশ এলাকায় প্রভাবশালী সরকারি বেসরকারি লোকজন অবৈধভাবে গ্যাসের ব্যবহার করছে।
‘কেবল বিচ্ছিন্ন অভিযানের মাধ্যমে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা বা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এজন্য সারাদেশে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা জোরদার করতে হবে’ বলছিলেন মন্ত্রণালয়ের আরও একজন কর্মকর্তা।
গত মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযান পরিদর্শন শেষে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ‘এদেশে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারিরা যতোই প্রভাবশালি হোক, শেষ অবৈধ সংযোগটি থাকা পর্যন্ত তিতাস গ্যাস এন্ড ড্রিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানীর অভিযান অব্যাহত থাকবে। সরকার চাচ্ছে দেশে কোন অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহার না হোক তাই আমরাও অবৈধ ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। অবৈধ গ্যাস সংযোগের সাথে তিতাসের কেউ জড়িত থাকলে সেও অপরাধী। পাশাপাশি অপরাধীদের ধরার জন্য আমরা উৎপেতে আছি।’
তিনি সেদিন আরও জানান, অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৫৪ জন ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত এবং ৩০ জন কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে।’
কালের আলো/ডিএস/এমএম