বাজারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

প্রকাশিতঃ 10:40 am | August 27, 2022

প্রভাষ আমিন:

বাজার যেন এখন এক আতঙ্কের নাম। বাজারে না গিয়েও উপায় নেই। আবার বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সাধ্যও অনেকের নেই। কোনও উপলক্ষ পেলেই আমাদের ব্যবসায়ীদের ঈদ লেগে যায়। করোনা এসেছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়াও। যুদ্ধ লেগেছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়াও। বন্যা হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়াও। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়াও। রোজা এসেছে, দাম বাড়াও। ঈদ এসেছে, দাম বাড়াও। উছিলা আসতে দেরি, দাম বাড়াতে দেরি হয় না। আসলে খলের কখনও ছলের অভাব হয় না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে বৃষ্টি হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে আর বৃষ্টি না হলেও বাড়ে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে, সব পণ্যের দামই কমবেশি বাড়বে; এটা প্রত্যাশিতই। কিন্তু কতটা বাড়বে? জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সরকার বাস ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদিও বাস মালিকরা আগে থেকেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি আদায় করছিল। এখনও খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রতিটি রুটেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় হচ্ছে। তারপরও বাসের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত একটি ভাড়ার তালিকা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার যেন মুক্তবাজার অর্থনীতির এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে মুক্তভাবে দাম বাড়ানো যায়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খাতে কতটা প্রভাব পড়তে পারে, তার একটা হিসাব-নিকাশ সরকার আগেই করেছিল। কিন্তু সেটা পণ্যমূল্যে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার কোনও হিসাব মনে হয় কেউ করেনি। দাম যতটা বাড়ার কথা, বেড়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। একেক সময় তারা একেকটি পণ্যকে পুঁজি করে রমরমা ব্যবসা করে। কখনও চাল, কখনও পেঁয়াজ, কখনও মরিচ, কখনও তেল, কখনও চিনি হয়ে যায় তাদের ব্যবসার হাতিয়ার। যেমন, এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর তারা টার্গেট করে ডিমকে। ৪০ টাকা হালির ডিম উঠে যায় ৬০ টাকায়। এক হালি ডিম পরিবহন করতে নিশ্চয়ই ২০ টাকা বাড়তি খরচ হয়নি। মুরগিও নিশ্চয়ই ডিম পাড়ার আগে ডিজেল খায় না। তাহলে ডিমের দাম এত বাড়লো কেন? কারও কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর নেই। কেউ দায় নিতে রাজি নয়। কিন্তু ফাঁকতালে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে ৬০০ কোটি টাকা ছিনতাই করে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। ডিমের দাম কমে এসেছে।

তাতেই সরকার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু আমার দাবি, কারা এই ডিমের দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী, গোপনে হলেও সরকার যেন সেটা তদন্ত করে। কারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা না থাক, অন্তত চিনে রাখুন। ভোক্তা অধিকার অধিদফতর মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে কিছু জরিমানা করে বটে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হন একদম সামনে থাকা খুচরা দোকানদার। কিন্তু দাম বাড়ানোর আসল দায়ীরা সবসময় আড়ালেই থেকে যান। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সেই সিন্ডিকেটের মুখোশ খুলতে না পারলে, তাদের শাস্তি দিতে না পারলে কখনও বাজার স্বাভাবিক হবে না। আজ হয়তো ডিম নিয়ে কারসাজিটা হয়েছে। সরকারও ডিমের পেছনে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কে জানে আড়ালে অন্য কোনও পণ্য তৈরি করছে সেই সিন্ডিকেট। তখন সরকার আবার সেই পণ্যের পেছনে দৌড়াবে, তখন আড়ালে তৈরি হবে আরেক পণ্য। এই চক্র ভাঙতে না পারলে, আড়াল সরাতে না পারলে; সরকার কখনও বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে না।

উন্নত বিশ্বে দেখেছি, কোনও উৎসবের আগে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়। হিসাবটা সহজ, কম লাভ, কিন্তু বিক্রি বেশি। তাতে ফাইনালি লাভ বেশি হয়। অর্থও বাজারে অনেক বেশি হাতবদল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টো। উৎসব এলেই দাম বেড়ে যায়, চাহিদা বাড়লেই দাম বেড়ে যায়। দাম বাড়তে পারে বা চাহিদা বাড়তে পারে; এমন গন্ধ পেলেই ব্যবসায়ীরা মজুত করে ফেলেন, সরবরাহ কমিয়ে দেন। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারেও দাম বেড়ে যায়, কম দামে কেনা জিনিসও বেশি দামে বিক্রি করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে ব্যবসায়ীরা বলেন, কম দামে পণ্য আসতে অনেক সময় লাগবে।

অনেকে বলেন, বাজা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে একে ছেড়ে দেওয়া উচিত। চাহিদা ও সরবরাহ নীতিতে বাজার ঠিক হবে। শুনতে ভালোই লাগে। যদি আমাদের ব্যবসায়ীরা ন্যূনতম এথিক্স মেনে চলতেন, তাহলে এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতো। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা লাভ আর লোভের পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলেন। তাই বাজারের ওপর সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার। বেশি নজরদারি করলেও ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে বাজারে আগুন লাগিয়ে দেন। তাই সরকার সেটা সবসময় করতে পারে না। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সরকারও ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। তবে সরাসরি না হলেও বাজারের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতেই হবে। আড়ালে কোনও পণ্য নিয়ে জুয়া খেলার জন্য ব্যবসায়ীরা তৈরি হচ্ছেন, তা যেন অন্তত আগে থেকে জানা যায়, যাতে সরকার প্রস্তুতি নিতে পারে।

বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে অসহায় সেটা বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় টের পাওয়া যায়। ভোজ্য ‘তেল নিয়ে তেলেসমাতি’র সময় একবার তিনি অসহায় কণ্ঠে বলেছিলেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করাটা ভুল ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর চালের দামে উল্লম্ফন নিয়েও বাণিজ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে অসহায়ত্ব, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চালের মূল্য প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বাড়তে পারে। কিন্তু কেজিতে ইতোমধ্যে দাম বেড়েছে ৪ টাকা। কেজিতে এত টাকা দাম বাড়ার কোনও যুক্তি আছে?’ এই প্রশ্ন তো আমরা বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে করবো। কেন ৫০ পয়সার বদলে ৪ টাকা বাড়লো? সরকার কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? বাণিজ্যমন্ত্রী এই প্রশ্ন কার কাছে করলেন? বাণিজ্যমন্ত্রীর কাজ ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ঠকা নয় বা অসহায়ের মতো প্রশ্ন করা নয়। তার দায়িত্ব হলো, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। ৫০ পয়সার বদলে ৪ টাকা কারা বাড়ালো, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া। ব্যবসায়ীরা যেন বাজারের নিয়ন্ত্রক হতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা।

সরকার নানা উন্নয়ন করছে, জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ উন্নয়নশীল হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় সেতু, টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। কিন্তু নিত্যপণ্য যদি সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে না থাকে, তাহলে কোনও উন্নয়নেই কিন্তু তাদের পেট ভরবে না।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।