নারী : প্রাণ, জীবন, মুক্তি

প্রকাশিতঃ 11:04 am | October 22, 2022

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :

মাত্র ২২ বছরের এক নারী মাহশা আমিনি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর খুন হয় ইরানের ঘাস্ত-ই-এরশাদ বা তথাকথিত নীতি পুলিশি নির্যাতনে। তারপর থেকে ইরান যেন অগ্নিগর্ভ। শুধু নারীরা নয়, ইরানের সাধারণ মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। তারা জীবন চায়, বাঁচতে চায়, মুক্তি চায়।

মাহশা আমিনির অপরাধ কী ছিল? তার হিজাবের আড়াল থেকে একটুখানি চুল বেরিয়ে এসেছিল। আর সে কারণেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ইরান রাষ্ট্র মনে করে তার নীতি পুলিশ একজন মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করে কোন অপরাধ করেনি। এতেই পরিষ্কার যে, ইরানে নারীর মর্যাদা কোন স্তরে। সে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এবং তাই শুধু নারী নিপীড়ন নয়, মানুষের এই অমর্যাদার বিরুদ্ধে আজ রাজপথে ইরানের সব শ্রেণি পেশার মানুষ। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইরান এক নিপীড়ক রাষ্ট্রের প্রতীক যে দেশের সব নীতি ও আদর্শ বর্বরতার আদর্শে লালিত।

ইরানের নারীরা বরাবরই এই ধর্মীয় পান্ডাদের কাছে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। নারীদের বলা হয় অনুশাসনে থাক, আর পুরুষগুলো বহুগামিতায় অভ্যস্ত। আসলে এই ধর্মীয় শাসক নারীদের ভয করে। তাই এবার ইরানের লড়াইয়ের শ্লোগান – জান, জিন্দেগি, আজাদি বা প্রাণ, জীবন, মুক্তি

১৯৭৮-৭৯ এর সেই বিপ্লবের পর থেকেই আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও তার অনুসারীদের পছন্দের টার্গেট নারীরা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব নিয়ম প্রণিত হয়েছে নারীকে লক্ষ্য করে। প্রতিটি আইনেই নারীকে দেখা হয়েছে অত্যন্ত ধর্মীয় রক্ষণশীল জায়গা থেকে।

গত ৪৩ বছরে এই দেশের প্রতিটি দিন রচিত হয়েছে মানুষকে বেহেশতের স্বপ্ন দেখিয়ে নিপীড়ন করে, হত্যা আর জেলে ভরে। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পরেই, আয়াতুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা করেন, সাত বছরের ঊর্ধ্বে সমস্ত মেয়ে কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে, হিজাব পরে, তবেই জনসমক্ষে বাইরে আসতে পারবে।

এই শরিয়তি আইনের অন্যথা হলে, ইসলামিক দণ্ডবিধি অনুযায়ী কারাদণ্ড, জরিমানা ও বেত্রাঘাতের বিধান আছে ইরানে। ইরানের নীতি পুলিশের পছন্দ বেত্রাঘাত এবং তাতেই মারা গেছে মাহশা আমিনি।

এবার ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর যে প্রতিবাদ তা আর কিছু নয়, বরং বলা যায় ইরানের রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের বিরুদ্ধে জনতার যুদ্ধ। প্রতিবাদকারীরা যে নিপীড়নের মুখে পড়েছে, যে অত্যাচার তাদের সইতে হয়েছে, প্রচন্ড রাষ্ট্রীয় গোগীনীয়তায় তার ছিটেফোটাও যে আসে তাতে ভয়ে শিহরিত হতে হয়। জেলের ভেতরে আগুন লাগিয়ে মানুষকে পুড়িয়েও মেরেছে ইসলামি ইরান।

ইরানে ধর্ম এত বেশি বড় যে, মানুষ নিজেকে আর মানুষই ভাবতে পারেনা। তাই মানুষ এবার জেগে উঠেছে। তারা ভাবছে বেঁচে থেকেও যদি মরেই থাকতে হয় তাহলে বাঁচার ওপরে আর ধর্ম কী? রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ ও দমনের হাতে মার খেতে খেতে তারা ভাবছে এবার তাহলে বাঁচার লড়াইটাই করতে হবে। তাই নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, পুলিশি নিপীড়নে পর মাহশা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে গোটা দেশ যে বিপুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, তা আসলে প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা। এই অবদমিত মানুষ ভাবছে রাষ্ট্রের কাছে মাথা হেট করে আর কতকাল থাকা যায়? ইরানের মানুষের আন্দোলন তাই মানবসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার এক বড় লড়াই।

ধর্ম অতি ব্যক্তিগত বিষয়। ইরানের মানুষ এবার সেটাই জোর গলায় বলতে চাচ্ছে। যে হিজাব ঠিকভাবে না পরার অপরাধে মরতে হয়েছে আমিনিকে, এত দিনের সেই শৃঙ্খল সেই পোশাক-কে প্রকাশ্য রাস্তায় ছুড়ে ফেলছে আগুনে। নিজেদের চুল কেটে পতাকা হিসেবে উড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়। পোশাকহীন উন্মুক্ত শরীরে প্রতিবাদ করেছে রাজপথে নেমে। জমায়েত, পথ-নাটক, গান সবই চলছে। প্রতিবাদ এখন আর শুধু নারীর নয়, এই আন্দোলন পুরুষের, শুধু তারুণ্যের নয়, সব বয়সের।

ইরানে এবারের আন্দোলন অনেক ব্যাপক। কিন্তু ইরানে প্রতিবাদ নতুন নয়। ইরানে জিনিসপত্রের দাম আনেক বেশি এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ অনেক দিনের। অনেক জায়গায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহও নেই ইরানে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাভাবিক নাগরিক সেবাও নেই। প্রতিবারই এসব প্রতিবাদকে নির্মমভাবে প্রতিহত করেছে কট্টর খোমেনির মতাদর্শের শাসক। রাষ্ট্র খুন করেছে অজস্র মানুষকে।

মাহশা আমিনির মৃত্যু প্রতিবাদকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে মানুষ আসলে ক্ষিপ্তই ছিল বহু বছর ধরে। ইরানের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় এবং মানুষের ভেতর সেই ক্ষোভটাও বড় আকারে কাজ করছে। হিজাব একটি প্রতীক মাত্র। ইরানের মানুষ চার দশকের বেশি সময় ধরে এই ধর্মীয় শাসনে থেকে বুঝেছে- এরকম শাসন ব্যবস্থা মানেই ঘৃণার শিক্ষা, বিধিনিষেধ আর নিপীড়ন। এই শাসন ব্যবস্থা সমৃদ্ধি আনেনা, রাষ্ট্রকে গরিব করে। তাই মানুষ এবার রাস্তায় ক্ষুধার পরিচয়ে, অবদমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, অন্ধকার থেকে আলতো যেতে।

রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের এত বড় বিক্ষোভ ইরান আগে দেখেনি। কারণ এবার মানুষ বাঁচার লড়াইয়ে নেমেছে। তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসনের নামে রাষ্ট্র তাদের প্রতিনিয়ত মারছে, খুন করছে।

ইরানের নারীরা বরাবরই এই ধর্মীয় পান্ডাদের কাছে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। নারীদের বলা হয় অনুশাসনে থাক, আর পুরুষগুলো বহুগামিতায় অভ্যস্ত। আসলে এই ধর্মীয় শাসক নারীদের ভয করে। তাই এবার ইরানের লড়াইয়ের শ্লোগান- জান, জিন্দেগি, আজাদি বা প্রাণ, জীবন, মুক্তি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।