ঢেলে সাজানো হচ্ছে প্রশাসন
প্রকাশিতঃ 10:22 am | October 27, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। এই পদে এখনও নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়নি সরকার। মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আখতার হোসেন চাকরি শেষে স্বাভাবিকভাবেই অবসরে গেছেন। তাকে অবসর দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়েছে প্রজ্ঞাপন। জননিরাপত্তা বিভাগও এখন সচিব শুন্য। তড়িঘড়ি করে এই পদে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব পদ শূন্য হচ্ছে। এসব পদে নতুন কোনো কর্মকর্তাকে দায়িত্বে আনার আগে চূলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যারা এই পদগুলোতে অভিষিক্ত হবেন তারাই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজে স্বভাবতই সম্পৃক্ত থাকবেন। ফলে তাড়াহুড়া না করে বিভিন্ন হিসাব নিকাশ কষেই এই পদগুলোতে যোগ্যদেরই আনতে চায় সরকার। সব সময়ই প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া এবারও অনুসরণ করা হচ্ছে।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে সব সময় কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রতিযোগিতা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। তারা চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। কারণ আর এক বছর কয়েক মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সার্বিক রাজনীতির গতি প্রবাহ কোন দিকে যাবে- এ ভাবনা তাদের মাথায় কাজ করছে।
বর্তমান সরকারের তিন দফায় যারা পদোন্নতি ও কাঙ্ক্ষিত মন্ত্রণালয়ে পদায়নের জন্য সরকারদলীয় সমর্থিত তকমা নিয়েছেন, এখন তাদের কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নিতে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন। পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এমন চিত্র বেশি দেখা যাচ্ছে।
একাধিক সূত্রে বলছে, জেলা প্রশাসক ও জেলার পুলিশ সুপারসহ মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানা সূত্র থেকে খোঁজখবর নেওয়ার রেওয়াজ দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসছে। এক্ষেত্রে যাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে, তিনি সরকারের প্রতি অনুগত কিংবা বিরোধী পক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যোগসূত্র আছে কিনা তা দেখা হয়ে থাকে। নানা কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় এখন নির্বাচনী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে কোনো পদে কোনো কর্মকর্তাকে পদায়নের ক্ষেত্রে দফায় দফায় খোঁজ নেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিষয়ে। তারপর তাদের পদায়ন করা হচ্ছে।
গত আগস্টে ৪০ জেলার পুলিশ সুপারকে পদায়নের ক্ষেত্রে দফায় দফায় একাধিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য যাচাই বাছাই করা হয়। জেলা প্রশাসকদের পদায়নের ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রক্রিয়া মেনে চলা হচ্ছে।
জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন অবসরে যাচ্ছেন ৩০ অক্টোবর। জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) র্যাব ও পুলিশের শাখা রয়েছে। মো. আখতার হোসেন গত ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনকালে এই বিভাগ মূলত নির্বাচনের শান্তি শৃঙ্খলা ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ জন্য এই বিভাগে সচিবের পদে বসাতে সরকার একজন দক্ষ ও আস্থাভাজন কর্মকর্তা খুঁজছে।
শীর্ষ পদ শূন্য হতে যাওয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিভাগ হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ বিভাগ সরকারের মন্ত্রিসভার সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে। এ বিভাগ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এ বিভাগ থেকে কার্যবিধিমালা এবং মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে কার্যবণ্টন করাসহ মন্ত্রিসভা ও কমিটিগুলোর সাচিবিক সহায়তা প্রদান, মন্ত্রিসভা ও কমিটির সিদ্ধান্তগুলোর অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন পর্যালোচনাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা হয়ে থাকে। এ বিভাগের সচিব পদে সাধারণত পদায়ন করা হয় প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সচিবকে। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দুবছরের চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বর মাসে। কে হবেন তার স্থলাভিষিক্ত- এ নিয়ে প্রশাসনে জোর আলোচনা হচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পদ। মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদও শেষ হবে এ বছরই। মুখ্যসচিব পদে কে নিয়োগ পেতে পারেন, তা নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন।
একজন সিনিয়র সচিব ধারণাস্বরূপ বলেন, মুখ্য সচিব পদের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার জ্যেষ্ঠ। তারপর আসতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদও শূন্য হচ্ছে। এ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজমের মেয়াদ ২ নভেম্বর শেষ হচ্ছে। এ পদের জন্য মাঠপ্রশাসনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সাধারণত নিয়োগ দেয় সরকার। নির্বাচনের সময় এ মন্ত্রণালয় মাঠপ্রশাসনে নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ পদের জন্য সরকারের প্রয়োজন আস্থাভাজন একজন কর্মকর্তা, যিনি নির্বাচনকালীন মাঠপ্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত চাকরির মেয়াদ থাকা এক কর্মকর্তা এই পদে সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছেন।
চাকরির বয়স অনুযায়ী, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অবসরে যাবেন ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান অমিতাভ সরকার। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন আল রশিদ, বিপিএটিসির রেক্টর রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব এম খলিলুর রহমান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এম সাইদুল ইসলাম এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব এম মোকাম্মেল হোসেন।
শূন্য পদ পূরণ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কয়েকটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। শূন্য পদে জ্যেষ্ঠতার সঙ্গে যারা সরকারের আস্থায় উপনীত হবেন, তাদেরই পদায়ন করা হবে। প্রশাসনে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া হয় বেশ হিসাব-নিকাশ করে।
কালের আলো/ডিএস/এমএম