প্রধান বিচারপতির নানা উদ্যোগে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব

প্রকাশিতঃ 10:26 am | October 31, 2022

কালের আলো রিপোর্ট :

দুর্ভোগ নিত্য সঙ্গী ছিল বিচার বিভাগে। প্রায় ৪২ লাখ মামলার ভারে কাহিল হয়ে পড়েছিল এই বিভাগ। মামলা জটের মুখে হয়েছেন নি:স্ব। কঠিন এই বাস্তবতায় বিচার বিভাগে দুর্ভোগ কমাতে যুগান্তকারী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তাঁর কার্যকর কর্মকৌশলে অনেকটাই লাঘব হতে শুরু করেছে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানা যায়, ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে এস কে সিনহার পদত্যাগের পর বিচার বিভাগের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। ঝিমিয়ে পড়ে বিচার কার্যক্রম। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিচার কার্যক্রমে গতি ফেরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলো মনিটরের জন্য তিনি গঠন করেন মনিটরিং কমিটি। ফলে গত কয়েক মাস যাবত গতি ফিরে এসেছে মামলা নিষ্পত্তিতে।

শুধু তাই নয়, বছরের পর বছর কারাগারের কনডেম সেলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের বিষয়টি দেখে দুটি অবকাশে হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। এ দুটি অবকাশে অন্তত ৬০টির মতো ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব ডেথ রেফারেন্সে আসামি ছিল অন্তত দেড়শ। এসব ডেথ রেফারেন্স ২০১৬ ও ১৭ সালে হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছিল।

একই সঙ্গে ‘ন্যায়কুঞ্জ’ নামে বিচারপ্রার্থীর জন্য সব আদালতে বিশ্রামাগার স্থাপন করা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়কুঞ্জ যাত্রা শুরু করেছে। এতে করে বিচারপ্রার্থীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এসব ন্যায়কুঞ্জে থাকবে দুটি করে টয়লেট, ওয়াশরুম ও বিচারপ্রার্থীদের বসার ব্যবস্থা। পাশাপাশি বিচারকাজে উৎসাহ বাড়াতে বিচারকদের জন্য প্রধান বিচারপতি পদক দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নীতিমালা অনুযায়ী, বিচারকাজে সরাসরি নিয়োজিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মোট ছয়টি পদক দেওয়া হবে। পদক প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ১২ মাসের নিরবচ্ছিন্ন বিচারিক কার্যক্রম বিবেচনায় নেওয়া হবে।

একই সূত্র বলছে, বিচারকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, গ্রেডেশন লিস্ট হালনাগাদকরণসহ বিচার বিভাগের আধুনিকায়নের দিকেও নজর দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি প্রধান বিচারপতি সরাসরি তদারকি করছেন।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া এবারই প্রথম অধস্তন আদালত মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিয়মিত মনিটরিং হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তি বেড়েছে।

সূত্র জানায়, গত জানুয়ারিতে সারা দেশের অধস্তন আদালত মনিটর করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের আট বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা আটটি বিভাগের দায়িত্ব পান। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামকে ঢাকা বিভাগ, বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে খুলনা বিভাগ, বিচারপতি জাফর আহমেদকে বরিশাল বিভাগ, বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লাকে চট্টগ্রাম বিভাগ, বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানকে সিলেট বিভাগ, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনকে রংপুর বিভাগ, বিচারপতি মো. জাকির হোসেনকে ময়মনসিংহ বিভাগ এবং বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানকে রাজশাহী বিভাগের আদালতগুলো মনিটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটির সভাপতিরা বিভিন্ন সময়ে দেশের আটটি বিভাগের অধস্তন আদালতগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তিতে দিকনির্দেশনা দেন।

গত সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, আদালতগুলো নিয়মিত মনিটরিং করায় গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মামলার নিষ্পত্তি বেড়েছে গড়ে ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যে পরিমাণ মামলা দায়ের হয়েছে, তার প্রায় ৯২ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে।

ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সব বিভাগে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মামলা হয়েছে ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭৬টি। একই সময়ে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে দেশের সব বিভাগে একত্রে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে সর্বমোট ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫২টি। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছয় মাসে দেশের সব বিভাগে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির পরিমাণ হলো গড়ে ৯১ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এদিকে, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আটটি বিভাগে মামলা হয়েছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮১টি। অথচ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে দেশের সব বিভাগে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩১১টি।

সূত্র জানায়, ২০০০ সালের আগে দায়ের হওয়া মামলা অগ্রাধিকারভিত্তিতে আগামী ১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত জুলাইতে এক পত্রে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ২২ বছরের অধিককাল মামলা বিচারাধীন থাকায় আদালত তথা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত থাকা মামলা ছাড়া ২০০০ সাল ও তার আগের মামলাগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের (বিজেএস) সদস্য বা অধস্তন আদালতের বিচারকদের জ্যেষ্ঠতার ক্রম বা গ্রেডেশন লিস্ট না থাকায় প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এ জন্য দীর্ঘ সাত বছর পর গ্রেডেশন তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের পর বিজেএস সদস্যদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা সংশোধন বা পুনঃপ্রণয়ন হয়নি।

কালের আলো/এসবি/এমএম