এক ম্যাচে বাংলাদেশের দুই জয়!
প্রকাশিতঃ 10:54 am | October 31, 2022
প্রভাষ আমিন :
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ দুবার জিতেছে! ক্রিকেটে এই লাইনটি সঠিক নয়। এক ম্যাচে একটি দলের পক্ষে দুবার জেতা সম্ভব নয়। কিন্তু যারা খেলাটি দেখেছেন তারা জানেন, লাইনটি পুরোপুরি মিথ্যাও নয়।
বাংলাদেশের ১৫০ রানের জবাবে তাসকিন আর মোস্তাফিজের তোপের মুখে শুরুতেই ধস নামে জিম্বাবুয়ের ইনিংসে। ৬৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে জিম্বাবুয়ে যখন ধুঁকছিল, তখন আশা জাগিয়ে রেখেছিলেন উইলিয়ামস। তারপর সেই ম্যাজিকেল রান আউট।
টুর্নামেন্টের এখন মাঝপথ। এখনই বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল। তবে ভারত বা পাকিস্তানের বিপক্ষে অন্তত একটি জয় যদি পায় বাংলাদেশ, আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।
সাকিব আল হাসান চিতার ক্ষিপ্রতায় যেভাবে উইলিয়ামসকে রান আউট করেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া বোধহয় একেই বলে। তবে ম্যাচের সব নাটকীয়তা বোধহয় জমা ছিল শেষ ওভারের জন্য।
আগের তিন ওভারে ২২ রান দেওয়া মোসাদ্দেকের হাতে বল তুলে দেন সাকিব আল হাসান। শেষ ওভারের ৬ বলে জিম্বাবুয়ের জেতার জন্য দরকার ছিল ১৬ রান। প্রথম ৫ বলেই ম্যাচের পাল্লা একবার এদিকে হেলেছে তো আরেকবার ওদিকে। প্রথম ৫ বলে এক ছয়, এক চারে জিম্বাবুয়ে তুলে নেয় ১১ রান। আর মোসাদ্দেক তুলে নেন দুটি উইকেট। শেষ বলে জিম্বাবুয়ের জয়ের জন্য দরকার ৫ রান। ছক্কা হলে জয়, চার হলেও সুপার ওভার।
এমন নাটকীয় মুহূর্তে মোসাদ্দেকের বলে স্টাম্পড হয়ে যান মুজারাবানি। জয়োল্লাসে মাতে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়েও মন খারাপ করে মাঠ ছাড়ে। কিন্তু নাটকের তখনও শেষ হয়নি। সবাই মাঠ ছাড়ার পর আম্পায়ার নো বল ডাকেন। আবার দুই দলের খেলোয়াড়রা মাঠে ফেরেন। এবার শেষ বলে দরকার চার রান এবং সেটি ফ্রি হিট। কিন্তু মোসাদ্দেকের এই নাটকীয়তম শেষ বলে কোনো রান নিতে পারেননি মুজারাবানি।
বাংলাদেশ পায় ৩ রানের জয়। এই দ্বিতীয় জয়ের পর ভাষ্যকাররা বলছিলেন, ‘অফিসিয়াল উইনিং মোমেন্ট ফর বাংলাদেশ।’ আমি অনেকদিন ধরেই ক্রিকেট খেলা দেখি। কিন্তু দুই দলের খেলোয়াড়রা মাঠ ছেড়ে যাওয়ার পর আবার এক বলের জন্য ফিরে আসার মতো নাটকীয়তা কখনো দেখিনি। এবার টি-২০ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে প্রথম দুই ম্যাচে ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছিল।
প্রথম ম্যাচে হেরে যেতে বসা জিম্বাবুয়ে বৃষ্টির কল্যাণে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি পয়েন্ট কেড়ে নেয়। দ্বিতীয় ম্যাচে শেষ বলের নাটকীয়তায় পাকিস্তানকে হারায়। তবে তৃতীয় ম্যাচে এসে ভাগ্য আর তাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। বলা হয়, ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে। বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ম্যাচে অবশ্যই বাংলাদেশ সাহসী ছিল।
এই ম্যাচে বাংলাদেশের হিরো অনেক। ৫৫ বলে ৭১ রানের দারুণ ইনিংসে অশান্ত হয়ে ওঠা নাজমুল হোসেন শান্ত অবশ্যই ব্যাটিংয়ের নায়ক। ১৯ বলে ২৯ রান করা আফিফও পার্শ্বনায়কের ভূমিকায় দারুণ মানিয়েছেন। তবে ১৫০ রান ডিফেন্ড করার জন্য বোলারদের দারুণ কিছু করতে হতো। সেটা তারা করেছেন ষোলোআনা। শেষ ওভারের কথা তো আগেই বলেছি। বাংলাদেশ হেরে গেলে ভিলেন হতে হতো মোসাদ্দেককে। বাংলাদেশকে জিতিয়ে তিনি নায়ক বনে গেছেন।
সাকিব আল হাসানের ম্যাজিকেল রানআউট তো ম্যাচের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। আর এক ওভারে দুই উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজ একই সাথে নিজের ফিরে আসার গান শুনিয়েছেন, পাশাপাশি জিম্বাবুয়েকে চাপে রেখেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সুপার হিরো তাসকিন আহমেদই। প্রথম ওভারেই উইকেট তিনি যে ধ্বংসের সূচনা করেছেন, তা থেকে আর পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। ১৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তাসকিন এখন টুর্নামেন্টেরই সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
বাংলাদেশ এবার টি-২০ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশের যা সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স তাতে বাছাই পর্ব খেলতে হলে কী হতো, সেটা নিয়ে আমি নিজেই শঙ্কিত ছিলাম। সরাসরি খেলার সুযোগ পেলেও দুই নাম্বার গ্রুপে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্ত প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। তবে বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো প্রথম ম্যাচেই দুর্বল প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে শুরুটা হয় দারুণ।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গোহারা হারলেও জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে আবার দারুণ উজ্জীবিত। তিন ম্যাচে দুই জয় নিয়ে বাংলাদেশ এখন পয়েন্ট তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে। এই অবস্থান ধরে রেখে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে যেতে পারবে কি না, তার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। সামনে ভারত-পাকিস্তানের মতো কঠিন প্রতিপক্ষ তো আছেই, আছে অনেক যদি, কিন্তুও।
এবারের টুর্নামেন্টে যে স্টাইলের খেলা হচ্ছে, মানতেই হবে বাংলাদেশ সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। শুধু এবারের টুর্নামেন্ট বলে নয়, বাংলাদেশ বরাবরই টি-২০ ফরম্যাটে দুর্বল। এবারের টুর্নামেন্ট সামনে রেখে প্রস্তুতিও ভালো হয়নি। এবারের দলটিও প্রায় নতুন। কোচিং স্টাফেও বদল এসেছে। শ্রীধরণ শ্রীরাম এসে দলের লক্ষ্যটাই বদলে দিয়েছেন।
আমার মতে এবারের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো নির্ভার থাকতে পারা। এবার আসলে বাংলাদেশে দলের কাছে দেশের মানুষের কোনো প্রত্যাশাই নেই। এমনকি বোর্ডও আগামীর গান শোনাচ্ছেন। তাই প্রত্যাশার কোনো চাপ ছাড়াই খেলতে পারছে বাংলাদেশ। তবে বরাবরই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা সাকিব অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসীদের দুটি আয়োজনে গিয়ে আবার বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।
বোর্ডের চাপে অনিচ্ছায় একটাতে গিয়ে অসদাচরণ করেছেন, আরেকটিতে গেছেন বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই। সাকিব বাহিনী যখন অস্ট্রেলিয়ায় ব্যস্ত, তখন দেশে আবার শিরোনাম সাকিব- ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সাকিবের নাম আর ব্যবহার করছে না দুদক। মূলত শেয়ার কেলেঙ্কারির সাথে সাকিবের নাম আসার কারণেই দুদক নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাতে সাকিবকে বাদ দিয়েছে। অনেকে বলেন বিতর্কের উত্তাপ না হলে নাকি সাকিবের সেরাটা বের হয় না। বারবার তাই নিজেই বিতর্কে জড়ান এবং নিজের সাথে নিজে লড়েন।
টুর্নামেন্টের এখন মাঝপথ। এখনই বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল। তবে ভারত বা পাকিস্তানের বিপক্ষে অন্তত একটি জয় যদি পায় বাংলাদেশ, আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।
৩০ অক্টোবর, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।