হাত বাড়ালেই মিলছে অ্যান্টিবায়োটিক

প্রকাশিতঃ 10:03 am | November 19, 2022

কালের আলো রিপোর্ট:

হাত বাড়ালেই মিলছে অ্যান্টিবায়োটিক। অথচ সরকারি নিয়ম বলছে, চাইলেই কোনো ফার্মেসি ক্রেতার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে পারবে না। অ্যান্টিবায়োটিক কেনার জন্য অবশ্যই রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র থাকতে হবে। রাজধানী থেকে সারা দেশের এই চিত্র অভিন্ন। প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।

আবার সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের মোড়কে লাল চিহ্ন থাকবে, প্রায় দেড় মাস আগে এমন কথা জানিয়েছিলেন জাহিদ মালেক। কিন্তু ছয় মাসেও এই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। তাই অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহারে আরও কঠোর হতে নতুন আইন করতে চাচ্ছে সরকার। শিগগির সংসদে এই আইন পাস হলেই প্রয়োগ শুরু হবে।

রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হচ্ছে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই। ফার্মেসির কর্মীরা রোগ ও লক্ষণ শোনে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দিচ্ছেন। ফার্মেসির জন্য দেওয়া লাইসেন্সে এমন কাজ না করার নির্দেশনা রয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। কিন্তু কোনো ধরনের নজরদারি না থাকায় অবাধে চলছে অ্যান্টিবায়োটিক বেচা বিক্রি।

সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রায় এক লাখ ফার্মেসি রয়েছে। এসব ফার্মেসিকে নজরদারির আওতায় আনতে যে পরিমাণ লোকবল দরকার সেটি নেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ফলে বন্ধ করা যাচ্ছে না প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি। এর পাশাপাশি জনসচেতনতাও তৈরি হয়নি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে।

রাজধানীতে ফার্মেসি দিতে হলে দুই সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে নিতে হয় ড্রাগ লাইসেন্স। এরপরই ব্যবসা শুরু করা যাবে। ঔষধ প্রশাসনের লাইসেন্সের সঙ্গে বেশিকিছু শর্ত থাকে। এরমধ্যে প্রধান হচ্ছে কোনোভাবেই ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি করা যাবে না ওষুধ। যেসব ওষুধে নেশা হয় এবং মৃত্যু ঘটাতে পারে সেটি বিক্রি করা যাবে না। অ্যান্টিবায়টিকও বিক্রি করা যাবে না। রাজধানীর বেশির ভাগ ফার্মেসির ট্রেড লাইসেন্স ও ঔষধ প্রশাসনের লাইসেন্স থাকলেও নিয়ম মানতে দেখা যায়নি ওষুধ বিক্রিতে।

রাজধানীর মিরপুর, গুলশান, মগবাজার, শান্তিনগর, শাহবাগ, মিরপুর, খিলগাঁও, আজিজ কো-অপারেটিভ মেডিসিন মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বেশ কিছু ফার্মেসিতে দেখা গেছে, অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। কেউ দেখার নেই। ঠান্ডা, জ্বর, কাশি, পেট ব্যথাসহ নানান ছোটখাটো অসুস্থতার জন্য নেওয়া হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। যার মাধ্যমে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন রোগীরা। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কি কি ক্ষতি হতে পারে তার কোনো ধারণা নেই এই রোগীদের। এমনকি কয়দিন খেতে হবে তাও জানেন না তারা। ফার্মেসির কর্মী যা দিয়েছে তাই কিছু না ভেবে খেয়ে নেন রোগীরা। যা অদূর ভবিষ্যতে অতিমাত্রায় খারাপ কিছু বয়ে নিয়ে আসতে পারে রোগীদের জন্য।

শুধু তাই নয় বেশিরভাগ ওষুধ কোম্পানির ওষুধের মোড়কে এখনও লাল চিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি। তবে হাতে গোনা কয়েকটি ওষুধের মোড়কে লাল চিহ্ন রয়েছে বলেও জানান একাধিক দোকানি।

আদতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে। যেসব ব্যাকটেরিয়া সাধারণত মানুষের শরীরকে আক্রমণ করে, তারা দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের সংস্পর্শে থাকার কারণে ওইসব ওষুধ থেকে বেঁচে যাওয়ার কিছু ক্ষমতা অর্জন করে। এটাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে শিগগিরই ওষুধ আইন-২০২২ করতে যাচ্ছে সরকার। দ্রুতই আইনটি অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। আইনে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিটিউক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের মোড়কে লাল চিহ্ন ব্যবহারের। পরে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি এই সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন করে। পরে গত ১৮ মে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সহজে চেনার জন্য এর মোড়কে লাল চিহ্ন ব্যবহারের নির্দেশনা দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

আর গত ৪ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, ড্রাগস অ্যান্ড কেমিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয় না, কেউ কেনেও না। আমাদের এখানে যে কেউ চাইলেই ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পারে। তাই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইনের অভাব রয়েছে। এ কারণে আইন কঠিন করা হচ্ছে।’

ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের আট বিভাগের ৪২৭টি ফার্মেসিতে জরিপ করে দেখা গেছে, অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। দেশের ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ ফার্মেসির কর্মীরা।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এসএম সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকে লাল চিহ্ন ব্যবহারে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ছয় মাসের সময় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক কোম্পানিই তা মানছে আবার অনেকেই মানছে না। এখন আমরা আইনটি পাশের অপেক্ষায় আছি। তবে অ্যান্টিবায়োটিকে সচেতনতা বাড়াতে আমরা গত ছয় মাসে ওষুধ কোম্পানি, ফার্মেসির এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ৭৯০টি সভা করেছি।’

জানতে চাইলে শাহবাগে সোল ফার্মার বিক্রয়কর্মী রানা হোসেন বলেন, ‘দেশের অনেক নামকরা ওষুধ কোম্পানি এখনও লাল চিহ্ন ব্যবহার করছে না। যেমন জিথরক্স ৫০০ ট্যাবলেট, জিম্যাক্স ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট, জিথ্রোম্যাক্স ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট, ক্যাসপা-২০০ গত ১৮ মে দেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে কমিউনিকেবল মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ফ্লামিড আইভিসহ অনেক অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনের মোড়কে এখনও লাল চিহ্ন নেই।

কালের আলো/ডিএস/এমএম