আশা জাগানিয়া সীমান্ত সম্মেলনে শান্তির সুবাতাস সীমান্তে

প্রকাশিতঃ 9:50 pm | November 30, 2022

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত সীমানা পেরিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের ভেতর। ঘটে যায় প্রাণহানিও। মাস কয়েক মর্টার শেল-গোলাবারুদ এসে পড়ার পাশাপাশি সীমান্তঘেঁষে উড়তে দেখা যায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমানও। এসব ঘটনায় কড়া ভাষায় কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। সীমান্তরক্ষী পর্যায়ে কঠোর বার্তা জানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।দু:খ প্রকাশ করে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। কিন্তু সীমান্ত আর জিরো লাইনের মানুষের আতঙ্ক কাটেনি তখনও।

বাংলাদেশও কোন উসকানি বা ফাঁদে পা না দিয়ে আলাপ-আলোচনাতেই গুরুত্ব দেয়। অনেকটাই ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায় মিয়ানমারের রাজধানী ‘নেপিতো’তে অনুষ্ঠিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৫ দিনব্যাপী অষ্টম সীমান্ত সম্মেলনে। সম্মেলনের আগেভাগেই শান্তি ফিরে আসে আগের মতোন। পুরোদমেই স্বস্তি ফিরতে শুরু করে সীমান্তবাসীর মনে।

দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নীতি নির্ধারক পর্যায়ে ৫ দিনের টানা বৈঠক নিজেদের মধ্যকার নিরঙ্কুশ আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীতিতে সীমান্তে শান্তি রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগে একীভূত হয়ে কাজ করতে উচ্চারিত হয়েছে দৃঢ় অঙ্গীকার। উপলব্ধির জাগৃতিতে বিজিবি-বিজিপির বন্ধুতার সুসম্পর্কের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আকাঙ্ক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ বাড়িয়ে সীমান্তে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দিতে প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় দুই বছর দশ মাস পর অনুষ্ঠিত এবারের সীমান্ত সম্মেলন।

পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত ভাগাভাগি, সীমান্ত সুরক্ষায় দৃঢ়চিত্ত মনোভাবের বহি:প্রকাশ ও লক্ষ্যপূরণে সমর্পিতচিত্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকার নীতিতে অটল থেকে সীমান্ত ব্যবস্থাপনাকে মসৃণ ও নিরাপদ করতে সমস্যার উৎসে গিয়ে সমাধানে ব্রতী বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ’র নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল সত্য-সুন্দর ধ্বনিতে উচ্চকিত করেন দেশপ্রেমের অগ্রণী অবস্থান ও বন্ধুত্বের স্বর্ণালী সংযোগ সূত্র।

বিজিবি মহাপরিচালক আলোচনার টেবিলে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গেই মিয়ানমারের নিয়ম ভেঙে আকাশসীমা অতিক্রমের বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। এমন ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় স্থানীয়ভাবে শঙ্কা বা সংশয় তৈরি হয়। আর সেটি সীমান্তে শান্তির জন্য বাধা হিসেবেই মোটা দাগে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। গভীর চিন্তা ও বোধের বিন্যাসে ইতিবাচকতার অভিমুখে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘যদি ড্রোন, হেলিকপ্টার উড্ডয়নের প্রয়োজন হয়, যেন আমাদের তা অবগত করা হয়। আমরা যেন লক্ষ্য রাখতে পারি সীমান্ত অতিক্রমের বিষয় ঘটে কি না। তারা (বিজিপি) আশ্বস্ত করেছেন তথ্য শেয়ার করবেন এবং এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটবে না।’

শুধু তাই নয় বিজিবির অব্যাহত প্রয়াসেই সীমান্ত শান্ত রয়েছে- অর্জনের আলোকমালায় যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারের ইতিবাচক সাড়া ও কার্যকর পদক্ষেপের এই বিষয়টিও। ফলত মঙ্গলবারের (২৯ নভেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি সদর দপ্তরে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের তাৎপর্যপূর্ণ উচ্চারণ- ‘আমার যেটা মনে হয় এই বিষয়ে তারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ কারণেই পরবর্তীতে কিন্তু আমরা এ ধরনের ঘটনা পাইনি বা গোলা পতনের কোন ঘটনা ঘটেনি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে ভবিষ্যতেও তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে সীমান্তে পরিস্থিতি কোন ধরণের অবনতি যেন না হয়, এই বিষয়ে তারা খেয়াল রাখবেন।’

সামনে এগিয়ে চলার পেশাগত উচ্চাশার তুঙ্গ-তরঙ্গে চেতনা ও বিবেকের পাটাতনে দায়বদ্ধ থেকেই বিজিবিপ্রধান বলেছেন, ‘আমি আশা করি, এই সম্মেলনে গৃহীত ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কার্যকরী বাস্তবায়ন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি আরও সুসংহত হওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত অপরাধ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। এর পাশাপাশি দুই বাহিনীর মধ্যে বিভিন্নস্তরে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এই সম্মেলন একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলেও আমি মনে করি।’

৫ দিনের সীমান্ত সম্মেলনে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে ইতিবাচক আশ্বাস মিলেছে বলে পরশুর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন বিজিবি ডিজি মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ। জানিয়েছেন, আগের তুলনায় রাখাইনের পরিস্থিতি ভালো। এটা রোহিঙ্গাদের ফেরতের জন্য ইতিবাচক।’

সীমান্তে অপরাধের লাগাম টেনে ধরতেও ঐক্যমতে পৌঁছেছে বিজিবি-বিজিপি। সম্মেলনে আন্তঃসীমান্ত অপরাধী চক্রের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের বিষয়টিও দায়িত্বশীলতার দীপ্ত শপথে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ, ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইসসহ অন্যান্য মাদক ও মানব পাচার রোধের বিষয়ে আলোচনা হয়। সীমান্তের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো, সীমান্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান, যৌথ টহল পরিচালনা, রিজিয়ন ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে নিয়মিত সমন্বয় সভা, পতাকা বৈঠক আয়োজনের বিষয়েও ঠাঁই পেয়েছে। এছাড়াও সীমান্তে আটক, সাজাভোগকারী উভয় দেশের নাগরিকদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়েও ফলপ্রসু
আলোচনা হয়েছে।

যৌথ টহল আর আশ্বাস-প্রতিশ্রুতির বৃত্তে আটকে নেই। এবারের সীমান্ত সম্মেলনে এই বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে দৃঢ়তার সঙ্গেই বিজিবি ডিজি বলেছেন, ‘সীমান্তে যৌথ টহলের বিষয়ে আশ্বাস নয়, সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা শিগগিরই শুরু হবে। আমি চাই এটাকে চলমান রাখা গেলে গ্রাউন্ড লেভেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি যোগাযোগ বাড়ানো গেলে এটি সম্ভব হবে, জোর দিয়ে বলছি আমি বাড়াবো।’

কালের আলো/এমএএএমকে