ই-কমার্স যখন প্রতারকদের খপ্পরে
প্রকাশিতঃ 11:24 am | December 05, 2022
প্রভাষ আমিন :
আমাদের ছেলে প্রসূন আমিন বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের সমর্থক। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সে এক অনলাইন বিক্রেতার কাছে ব্রাজিলের জার্সি অর্ডার করে। সে তাদের একশো টাকা অগ্রিমও দেয়। কয়েকদিন অপেক্ষা করে সে যখন খোঁজ নিতে গেল, তারপর থেকে সেই অনলাইন বিক্রেতা হাওয়া। আর ফোনও ধরে না, জার্সিও আসে না।
টাকার জন্য নয়, প্রসূনের দুঃখ জার্সির জন্য। সময়মতো জার্সি না পাওয়ায় তার মন খারাপ হয়। মাত্র একশো গচ্চা গেছে বলে আমরাও আর উচ্চবাচ্য করিনি। শুধু প্রসূন নয়, প্রতিদিনই এমন শত মানুষ অনলাইন মার্কেটে প্রতারণার শিকার হয়।
অনলাইনে কেনাবেচা বা ই-কমার্স এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। প্রযুক্তির বিস্তারের সাথে সাথে ই-কমার্সেরও ব্যাপক বিস্তার ঘটে। বিশেষ করে করোনার সময় ই-কমার্সই হয়ে ওঠে মানুষের আশ্রয়।
এই করোনোর সুযোগেই ই-কমার্স খাত দারুণ ভিত্তি পেয়ে যায়। কিন্তু দেখা গেল, আরও অনেক খাতের মতো সম্ভাবনার এই খাত প্রতারকদের দখলে চলে যায়। গণমাধ্যমেও অনলাইন মাধ্যমকেই ভবিষ্যৎ বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল।
সবাই ধারণা করছেন, সময়ের সাথে সাথে ছাপা পত্রিকার চাহিদা কমে আসবে, বাড়বে অনলাইনের দাপট। কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড সব অনলাইনের দাপটে মূলধারার অনলাইনের বিকাশই ঠিকভাবে হতে পারছে না। এভাবেই আমরা সব সম্ভাবনার গলা টিপে হত্যা করি।
ঘরে বসে পণ্য পাওয়া যায় বলে অনলাইন প্লাটফর্ম বা ই-কমার্স দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ই-কমার্স হয়ে দাঁড়ায় মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়া বা প্রতারণার মাধ্যম। সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করা, এক জিনিসের ছবি দেখিয়ে অন্য পণ্য সরবরাহ, মান ঠিক না রাখা তো সাধারণ অভিযোগ।
আইফোন অর্ডার করে আলু পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এই বাংলাদেশে। আইফোনের বদলে যারা আলু দিয়েছে, তারা তো তবু কিছু দিয়েছে। কিন্তু একদম পণ্য না দেওয়ার ঘটনাও কখনো কখনো ঘটে। আর প্রসূনের মতো অনেকের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ না করার ঘটনাও কম নয়।
প্রসূন তো তবু একশো টাকা ধরা খেয়েছে। কিন্তু ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিড ডট কম, কিউকম-এর মতো হাওয়াই কোম্পানির কাছে আগাম টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও অনেক।
এসব অনলাইনে লাখ টাকা ধরা খাওয়া অনেক মানুষ আছে আমাদের চারপাশেই। বিভিন্ন অনলাইনে আগাম টাকা দিয়ে মোট কত মানুষ ধরা খেয়েছেন, কত টাকা আটকে গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অনেকে লজ্জায় প্রতারিত হওয়ার কথা স্বীকার করেন না।
আমার ধারণা অনলাইনগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। ধরতে পারলে প্রতারকদের জেলে নেওয়া যাবে, কয়েকজন জেলে আছেনও। কিন্তু প্রতারিত মানুষেরা কখনো ফিরে পাবেন, তেমন সম্ভাবনা সামান্যই। কারণ হাওয়াই কোম্পানির হাওয়াই টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
প্রতারিত হওয়া মানুষদের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে। আমি চাই তারা টাকাটা ফেরত পাক। তবে প্রতারিত হওয়ার জন্য তাদের দায়ও কম নয়। বিভিন্ন সময়ে আমিও অনলাইনে কেনাকাটা করেছি।
পণ্যের মান নিয়ে অভিযোগ আছে; যে ছবি দেখে অর্ডার করেছি, হাতে পেয়ে তার সাথে না মেলায় মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু আমি কখনো প্রতারিত হইনি, আমার কোনো টাকা মার যায়নি। কারণ আমি কখনো আগাম টাকা দেইনি।
তারচেয়ে বড় কথা অস্বাভাবিক কম দামে কোনো পণ্য কিনতে কখনো প্রলুব্ধ হইনি। এখন আপনি যদি দেড় লাখ টাকা দামের মোটর সাইকেল এক লাখ টাকায় কিনতে চেয়ে অগ্রিম টাকা দেবেন, তখন তো আপনি নিজেই প্রতারকদের আমন্ত্রণ জানালেন।
টাকা দেওয়ার আগে আপনি একবারও ভাববেন না কেন, দেড় লাখ টাকার মোটর সাইকেল তারা কীভাবে এক লাখ টাকায় দেবে আপনাকে। আমাদের লোভকে পুঁজি করেই প্রতারকরা অনলাইনে ফাঁদ পাতে। আর আমরাও বুঝে না বুঝে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। যেহেতু নির্দিষ্ট শোরুম নেই, তাই অনলাইনে বিক্রেতারা বাজার থেকে কিছুটা কম দামেই পণ্য দিতে পারেন। কিছুটা কম দাম আর প্রায় অর্ধেক দাম তো এক নয়।
আমাজন বা আলিবাবার মালিকরা বিশ্বের সেরা ধনীদের তালিকায় থাকেন। আর আমাদের ই-ভ্যালি বা ই-অরেঞ্জের মালিকরা হয় কারাগারে, নয় পলাতক। আমরা কোনো সম্ভাবনাকেই বিকশিত করতে পারি না।
শুরুতে আমাদের অনলাইন গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছিল, স্বামী-স্ত্রী মিলে ডটকম বানিয়ে ব্যবসা করতেন; শুরুতে ই-কমার্সের বিস্তারটাও ঘটেছে কারো কোনো নজরদারি ছাড়া। তবে এই খাতটি যে দ্রুততায় বিস্তৃত হয়েছে, সময় এসেছে কঠোর আইনি কাঠামোয় আনার। এখানে যেহেতু মানুষের টাকা পয়সার লেনদেন হয়, তাই স্বচ্ছতা জরুরি, তারচেয়ে জরুরি সরকারের মনিটরিং।
ই-কমার্সের যে ভালো ব্যবসায়ী নেই, তা নয়। কিন্তু এক ই-ভ্যালি মানুষের আস্থায় যে ধস নামিয়েছে, হাজারটা দারাজও তা ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তাই নিজেরা ভালো ব্যবসা করলেই হবে না, কেউ যাতে ব্যবসা প্রতারণার মাধ্যম বানাতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
আশার কথা ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে সমবেত হয়েছেন। নিশ্চিত সরকারের অনুমতি ছাড়া, অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছাড়া কেউ যাতে কোনো ধরনের কেনাবেচা করতে না পারে। আর কোনো অনিয়ম ঘটলে তার প্রতিকার পাওয়ার উপায় থাকতে হবে।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ই-কমার্সই হতে পারে বেচাকেনার ভবিষ্যৎ, সাধারণ মানুষের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তবে তার আগে যারা প্রতারণা করেছেন, তাদের আইনের আওতায় এনে, প্রতারিতদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ