বিশ্ববিদ্যালয় তুমি কার? শিক্ষার্থীর না শিক্ষক-শিক্ষিকাদের?
প্রকাশিতঃ 11:21 am | January 31, 2018
শেখ আদনান ফাহাদ |
দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের একটা কথা প্রায়ই বলতে শোনা যায়, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অনেকের প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের মাথা নত হয়ে আসে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খুব কম শিক্ষক আছেন যাদের প্রতি তাদের মন থেকে শ্রদ্ধা আসে। নিজে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ব্যক্তিগতভাবে কখনো ইচ্ছে হয় না যে, কোনো ছাত্র বা ছাত্রী আমার পা ছুঁয়ে সালাম করবে। কিন্তু ঢালাওভাবে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের অবমূল্যায়ন বা অশ্রদ্ধাপোষণ কিংবা প্রকাশও মন থেকে সায় পায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, প্রকাশ্যে তুই-তুকারিতে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অথচ মনে করা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই স্কলার; শিক্ষক সিনিয়র স্কলার, শিক্ষার্থী জুনিয়র স্কলার। স্কলার মানেই তো প্রজ্ঞাবান হওয়ার কথা।
সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষিকা ও দুই শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যেটি সকলের জন্যই বিব্রতকর। শিক্ষিকা কর্তৃক ঘটনার বর্ণনা শুনলে মনে হবে সব দোষ শিক্ষার্থীদ্বয়ের, আবার শিক্ষার্থীদ্বয় এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করা কিছু শিক্ষার্থীর কথা শুনলে মনে হবে, ওই শিক্ষিকার চেয়ে খারাপ মানুষ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি কেউ নেই! ঘটনাস্থলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ২০ মিনিট ধরে নাকি সেই ‘ঝগড়া’ স্থায়ী হয়েছিল! ভিডিও ফুটেজ থাকলে পরিষ্কার হয়ে যেত কে কত ভালো, আর কে কত খারাপ! অবশ্য আগ বাড়িয়ে ভিডিও করলে এবং সে ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে নতুন কোনো আইনি এবং নৈতিক বিপদ এসে হাজির হতে পারে।
শিক্ষিকা-শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক সে ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীকে স্বল্প মেয়াদে শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শাস্তি বাস্তবায়িত হলে, শিক্ষার্থীদের অন্তত একজনের ইয়ার লস হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় বিধায় ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফেসবুকে তৈরি হয় জনমত। তাদের সতীর্থরা পরের দিন ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল করে এবং উপাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করে এ ঘটনায় ‘ন্যায়বিচার’ দাবি করে। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলেছেন, বিচার হলে দুই পক্ষেরই হবে, শুধু শিক্ষার্থীদের হবে কেন? এত দ্রুত সময়ের মধ্যে কেন বিচার হবে? শিক্ষার্থীদের উপাচার্য মহোদয় জানান, এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি, সুপারিশের পর্যায়ে আছে। ‘ন্যায়বিচার’ প্রাপ্তির আশ্বাস পেয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, আক্রান্ত শিক্ষিকা কি তার বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন না? শিক্ষার্থীরা কি তাদের সতীর্থের অপরাধ গোপন করতে চাইছে? কী চাইছেন তারা? শিক্ষার্থীদের অভিযোগ হচ্ছে, সেদিনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য শিক্ষিকারও দায় আছে। যদি আসলেই শিক্ষিকার দায় থেকে থাকে, তাহলে এই শিক্ষিকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কী পদক্ষেপ নেবে?
পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে, এখানে দুটো প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। একদিকে শিক্ষার্থী সমাজ, অন্যদিকে শিক্ষক সমাজ। কোনো শিক্ষক কোথাও আক্রান্ত হলে, কোনো বিপদে পড়লে তাকে রক্ষা করা, তার পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব শিক্ষক সমিতির। অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের যেহেতু ছাত্র সংসদ নেই, তাদের হয়ে বলার জন্য কোনো নিজস্ব কোনো সংগঠন নেই। তবে ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্বও অনেকে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উপরই বর্তায়। ছাত্র-শিক্ষক পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে গেলে মুসিবতে পড়ে প্রশাসন, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে উপাচার্য। সবাই দায় এড়িয়ে চলতে পারলেও উপাচার্যরা এটা পারেন না। সবাই মিলে এমন একটা ইম্প্রেশন দেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু করার দায়িত্ব শুধু উপাচার্যের। অথচ সবারই কম বেশি দায়িত্ব রয়েছে এবং এই দায়িত্ব পালনের জন্য সবাই বেতন-ভাতা তো নিচ্ছেনই, কেউ কেউ উপরি নানা সুবিধাও ভোগ করছেন।
ইদানীং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণার জন্ম নিতে দেখা যাচ্ছে। এই ছাত্র-ছাত্রীর দল মনে করে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ ভোগ-বিলাসে ডুবে আছে! এমনও বলতে দেখা গেছে যে, শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় ফ্রি বসবাস করেন। এক ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিল, বেতনের ৫৫ শতাংশ অর্থ শুধু ভাড়া বাবদ কেটে নেয়া হয়। সেই ছাত্রের চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নেতিবাচক ধারণার ডালপালা এমনই বিস্তৃত হয়েছে যে, এক ছাত্র একবার ফেসবুকে লিখেছিল, ক্লাস করে, পরীক্ষা দিয়ে তারা কোনো অর্থ পান না; তবে কেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেন পাবেন!! এই ছাত্র যদি বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করে আর শিক্ষা সচিব হয়, তাহলে শিক্ষক সমাজের কপালে কী ঘটবে, সেটি ভেবে আমি আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম। খুবই হাস্যকর আর ছেলেমানুষি ছিল সে ছাত্রের মন্তব্য। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অফিস টাইম নিয়েও কদিন আগে বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন ৮টায় অফিসে ঢুকে না, কেন সারাদিন অফিসে থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এই ছাত্র-ছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন রুটিন থাকবে, কেন তারা রুটিন করে নিয়মিত ক্লাসে আসতে বাধ্য হবে, ইত্যাদি বিষয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক শুরু করেছিল।
রেজাল্ট নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগের অন্ত নেই। যে ভালো মার্কস পায়, তার কাছে স্যারেরা ভালো মানুষ, যে পায় না তার চোখে সবাই ভিলেন। কিন্তু একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব কিন্তু সবার। তবে শিক্ষক-শিক্ষিকা বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নানা বাস্তবসম্মত এবং আজব-অদ্ভুত ধ্যান ধারণার দায় কিন্তু শিক্ষক সমাজ এড়াতে পারেন না। তবে যে ছাত্র-ছাত্রী স্যার-ম্যাডামদের ব্যাগ বহন করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন, তারাও কি অনৈতিকতা চর্চা করেন না? আবার যে শিক্ষক-শিক্ষিকা কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীর অতিভক্তি পছন্দ করেন, লাই দেন তারাও নিঃসন্দেহে অনৈতিক কাজে উৎসাহ দাতা বা দাত্রী। রক্ত মাংসের মানুষের পক্ষে নির্মোহ নৈর্ব্যক্তিক হওয়া খুব কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই সবাইকে করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই ফেরেশতা নন। অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছেন যারা কারণে-অকারণে টিচারদের সাথে বেয়াদবি করেন। আবার টিচারদেরও কেউ কেউ নিতান্তই অযৌক্তিকভাবে একটা প্রভু-ভাব নিয়ে চলাফেরা করেন। সালাম দিলে সালামের উত্তর দেন না, তাদের মন রক্ষা করতে করতে ছাত্র-ছাত্রীদের বারোটা বেজে যায়। নিজ বিভাগ ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম, এমনকি ফুলটাইম জব করতে দেখা যায় কোনো কোনো শিক্ষককে। আবার ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। নানা সংগঠনের ব্যানারে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের ঘর-বাড়িতে লাঠি-রড নিয়ে হামলা করে রান্নাঘর কিংবা বৈঠকখানায় ঢুকে ভাঙচুর চালাতেও দ্বিধা করে না। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে টেন্ডারবাজি হয়, চাঁদাবাজি হয়, নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ আসে সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে এই ছাত্র-ছাত্রীদেরই একটি অংশ। এসব দায় নিশ্চয় ছাত্র-ছাত্রীরা এড়াতে পারে না। নীতি কথা বললে, সততার সবক দিলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে সেই শিক্ষকের কাছে আর আসেই না।
এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের যে নেতিবাচক প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে তাকে রুখে দেয়া যায় কীভাবে? আমি মনে করি, সবার মাঝে সহিষ্ণুতা বাড়াতে হবে। নিজেকে পারফেক্ট ভাবা বন্ধ করতে হবে । শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই ধরাধামের রক্তমাংসের মানুষ। শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও বুঝতে হবে, তাদেরকে বিধাতা পারফেক্ট করে বানাননি। তাদের পক্ষে সবসময় সঠিক এবং যৌক্তিক কথা বলা, আচরণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। আবার ছাত্র-ছাত্রীরাও যদি নিজেদেরকে যৌক্তিকতার মানদণ্ডে বিচার করে সমঝে চলেন, তাহলে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা সম্ভব। একটি ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কি কি বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, কোন বিষয়ে বা ঘটনায় ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ, তাদের চিন্তার প্রবণতা কী এগুলো আগে থেকে জানা থাকলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটবেই না। আবার শিক্ষার্থীদের বেপরোয়া স্বাধীনতাও কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রের আইন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা বা শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। পরস্পর পরস্পরকে সম্মান করা শিখতে হবে। নিজেকে শুধু স্বার্থপরের মত ভালোবাসলেই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও সমান ভালোবাসতে হবে। উভয় পক্ষকেই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার বন্ধনে বাধতে হবে। সব সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, নিজেদের একটা ভুল কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তথা সমাজের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়