যুদ্ধ জয়ের সক্ষমতা দেখালো দামাল সেনারা, ‘স্মার্ট সেনাবাহিনী’ গড়ার দুর্বার অভিযাত্রায় সেনাপ্রধান

প্রকাশিতঃ 10:35 pm | January 05, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:

মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত চারপাশ। বহি:শত্রুর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই। বোমা ফুটছে অনবরত। শক্রপক্ষকে ঘায়েলে সাঁজোয়া যান নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ঠিক যেন যুদ্ধের দামামা। অব্যাহত আক্রমণে পর্যদুস্ত শত্রুরা। নিমিষেই ধ্বংস সব ঘাঁটি! অকুতোভয় দামাল সেনাদের সামনে টিকতে না পেরে অসহায় আত্মসমর্পণ।

হিমালয়সম সাহস, দৃঢ় মনোবল আর দক্ষতায় বিজয়ের হাসি বীর সেনাদের মুখে। উচ্ছ্বাসমাখা সুবর্ণ জয়ের জয়োধ্বনি কন্ঠে কন্ঠে। যার মাধ্যমে তারা দেখিয়েছে নিজেদের শক্তিমত্তা আর যুদ্ধ জয়ের সক্ষমতা। নতুন বছরের শুরুতেই বারতা দিলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেকোন পরিস্থিতিতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী। গল্পের বাস্তবিক এমন দৃশ্যপটেই টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় চূড়ান্ত মহড়ার মধ্যে দিয়ে বৃহস্পতিবার (০৫ জানুয়ারি) শেষ হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীতকালীন বহিরঙ্গণ প্রশিক্ষণ ‘অনুশীলন নবউদ্যোগ’। সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশন সফলভাবে এই অনুশীলন পরিচালনা করে। প্রায় এক দশক পর বৃহৎ পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনী পর্যায়ে এবারের শীতকালীন প্রশিক্ষণের শেষ দিনে চূড়ান্ত মহড়া অবলোকন করেন, প্রশিক্ষণে সরাসরি নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী স্মার্ট সেনাবাহিনী গড়তে নিজ বাহিনীর প্রশিক্ষণ সক্ষমতাকে যুগোপযোগী করতে প্রত্যয়ী শপথে দুর্বার অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। বলেই দিয়েছেন স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট সেনাবাহিনীই কাম্য। নতুন নতুন কৌশলের উদ্ভাবন ঘটিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিভিন্ন প্যারা মিলিটারি ফোর্সের সমন্বয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তিনি এই অনুশীলনের পরিকল্পনার সফল প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।

গত বছর প্রথমবারের মতো বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫০ বছর পূর্তিতে লজিস্টিক এফটিএক্স অনুশীলন যুগে প্রবেশ করে সেনাবাহিনী। সাঁজোয়া বহর ও এপিসি’র পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ছত্রীসেনা অংশগ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর আর্মি এভিয়েশনের হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আর্মি কমান্ডো সন্নিবেশ, ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ; পদাতিক ও অন্যান্য কোরের সমন্বয়ে শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণ পরিচালনা- কী ছিল না এবারের ‘অনুশীলন নবউদ্যোগ’ চূড়ান্ত মহড়ায়!

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বিদায়ী বছরের ১৯ ডিসেম্বর শীতকালীন প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সেনাসদর ও সেনাবাহিনীর সকল ফরমেশন পূর্ণাঙ্গর্রপে নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন হয়। জাতির গর্ব ও আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীতকালীন প্রশিক্ষণের প্রতিপাদ্য হলো ‘যুদ্ধ পারঙ্গমাতা, যুদ্ধোপযোগিতা ও রনপ্রস্তুতি প্রদর্শন’। দেশ সেবায় নিজেদের প্রস্তুত করে তুলতে সরেজমিনে বাস্তবধর্মী বিভিন্ন সামরিক বিষয়াদি অনুশীলনের মাধ্যমে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন সাধন করাই এই অনুশীলনের মূল লক্ষ্য। এছাড়া এ বছর শীতকালীন বহিরঙ্গণ অনুশীলনটিতে অধিকতর বাস্তবধর্মী ও অভিনব জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটানো হয়।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রশিক্ষণে ফোকাসের
টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় শীতকালীন প্রশিক্ষণের সমাপনী দিনে চূড়ান্ত মহড়া অবলোকন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। প্রশিক্ষণে দৃষ্টি নিবদ্ধের নির্দেশনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে আমাকে বলে দিয়েছেন যে, তুমি ট্রেনিংয়ের প্রতি সবসময় ফোকাস রাখবে, সেই জন্য আমরা কিন্তু অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ট্রেনিংয়ে অনেক বেশি ফোকাসড।’

ইতিহাসে চোখ রেখে সেনাপ্রধান বলে চললেন, ‘আপনি ইতিহাস খুঁজলে কখনোই বাংলাদেশে দেখতে পারবেন না যে, আর্মি লেভেল এক্সারসাইজ পরপর দুইবার হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, লাস্ট যখন আর্মি লেভেল এক্সারসাইজ হয়েছে সেটা হল ২০১২ সালে, তারপরে থেকে দশ বছর হয়ে গেছে। আমরা আর্মি লেভেল লজিস্টিকস এফটিএক্স করেছি গতবার, এবার আর্মি লেভেল সামগ্রিকভাবে এক্সারসাইজ করলাম। সেইভাবে এটা একটা ক্লিয়ার ইন্ডিকেটর যে আমরা কিন্তু ট্রেনিংয়ে অনেক ফোকাস রাখছি।’

ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর আধুনিকতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাচ্ছি যে আমাদের ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দিকনির্দেশনা এবং সার্বিক সহযোগিতায় এই ফোর্সেস গোল বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীর যে আধুনিকায়ন করা দরকার সেটা করা হচ্ছে। আর স্মার্ট বাংলাদেশের সাথে মিলিয়ে স্মার্ট সেনাবাহিনী হবে এটাই কাম্য।’

সেনাবাহিনীকে আরও স্মার্ট করতে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘যত জায়গায় আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে সেগুলো আমরা বাড়াচ্ছি। মান্ধাতা আমলের সিস্টেম থেকে বেরিয়ে সেনাবাহিনীর টিএডিএ, বেতন কাঠামো স্মার্ট একটা ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ভেতর নিয়ে আসছি। খুব শীঘ্রই এটার ফল সবাই দেখতে পারবে। আমি একটা প্রক্রিয়ার কথা বললাম। এভাবে সামগ্রিক সবক্ষেত্রেই আধুনিকায়নের সুবিধা আমরা নিচ্ছি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতটা স্মার্ট করা সম্ভব সেটা আমরা করছি।’

চূড়ান্ত মহড়া টাঙ্গাইলে, নেতৃত্বে নবম পদাতিক ডিভিশন
সেনাবাহিনীর শীতকালীন বহিরঙ্গণ প্রশিক্ষণ ‘অনুশীলন নবউদ্যোগ’র চূড়ান্ত মহড়ার সারসংক্ষেপ গণমাধ্যমকে জানান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পুরো সেনাবাহিনীর সারাদেশেই এক্সেসাইজ করছে। এই মেইন এক্সারসাইজ এলাকাটা হলো ১৯ পদাতিক ডিভিশনের। ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এখানে আছেন। আমরা দেখিয়েছি যে, এই এলাকা মুক্ত করতে ৯ পদাতিক ডিভিশন এখানে এসে এলাকাকে মুক্ত করতে আক্রমণ করেছে। ৯ পদাতিক ডিভিশনের মেজর জেনারেল শাহীনুল হকের নেতৃত্বেই আক্রমণ পরিচালনা করা হলো।

‘আপনারা দেখে থাকবেন যে, কিছুক্ষণ আগে ওখানে আবার ৯ পদাতিক ডিভিশন তারা কিন্তু দু:স্থদের জন্য চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা, যে তোমরা যেখানেই যাবে জনগণের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। ওনি সেদিনও পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে রাজারবাগে বলেছেন, যে জনগণের আস্থা যদি কোন বাহিনী অর্জন করতে না পারে তাহলে কিন্তু সেই বাহিনী তাদের সাফল্য লাভ করতে পারবে না। জনসমর্থন ছাড়া এই পৃথিবীর কোন সেনাবাহিনী কোন যুদ্ধ জয় করতে পারেনি’- যোগ করেন সেনাপ্রধান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশের মানুষ যাতে সেনাবাহিনীর প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখে এবং আমরা যদি সবসময় সার্বিকভাবে সহযোগিতা পাই, সেই জন্য আমরা সবসময় যখনই জনগণের ভেতর থাকি চেষ্টা করি তাদের কোন অসুবিধা না করে যতটা পারি তাদের হেল্প করার জন্য। সেই কাজটাই আমাদের ৯ পদাতিক ডিভিশন এখানে সুন্দরভাবে করছিল, আমি এসে তাদের সাথে একটু যোগ দিয়েছি। তাদেরকে উৎসাহ দেয়ার জন্য। আপনারা সবসময় সহযোগিতা করবেন যাতে করে সেনাবাহিনী তাদের প্রদত্ত দায়িত্ব সুন্দরভাবে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে পারে।’

প্রশিক্ষণ প্রস্তুতি চার মাস আগে থেকেই
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমাদের শীতকালীন প্রশিক্ষণ আজকে শেষ হচ্ছে। সেনাবাহিনী পর্যায়ের একটা প্রশিক্ষণ কন্ডাক্ট করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সেটা সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করেছে এবং বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। আমার সাথে আমার চিফ অব জেনারেল স্টাফ, কোয়াটার মাস্টার জেনারেল, পিএসও আমর্ড ফোর্সেস, চীফ অফ কন্ট্রোল-সবাই আছে।

এই প্রশিক্ষণের পরিচালনা এবং পরিকল্পনার জন্য সবাই কিন্তু দিনরাত পরিশ্রম করেছে। আপনারা মাঠে অ্যাকশন দেখলেন কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে প্রায় তিন চার মাস আগের থেকে। বলতে গেলে তারও অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়। আমরা মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, পরিকল্পনা যা করেছিলাম সেটা অলমোস্ট সম্পূর্ণভাবে আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।’

এ সময় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, আর্মি ট্রেনিং এন্ড ডকট্রিন কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহম্মদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও ঘাটাইলের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী, ৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হকসহ সেনাসদরের প্রিন্সিপাল ষ্টাফ অফিসাররা, অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/এমএএএমকে