কৌশলী ও পরিণত কূটনীতিতে ঢাকা

প্রকাশিতঃ 10:44 am | January 12, 2023

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরাশক্তি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ নতুন নয় মোটেও। নিজেদের মধ্যকার বিরোধ তুঙ্গে থাকলেও ভারসাম্যের কৌশলী কূটনীতিতে হাঁটছে বাংলাদেশ। কারও সঙ্গে বিরোধে না জড়িয়ে গভীর করেছে নিজেদের সম্পর্ক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায়ের এ কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। দু’দিন আগেও তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন বৈশ্বিক পরাশক্তির ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।’

তবে বিদায়ী বছরের শেষ লগ্নে বাংলাদেশ নিয়ে কৌশলগত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে ওয়াশিংটন ও মস্কো। সেখানেও কৌশলী ও পরিণত কূটনীতির পরিচয় দেয় ঢাকা। বড় শক্তিগুলোর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ওপর ভর করার এই প্রবণতায় বেশ সতর্ক দেশটি। ভারসাম্য রক্ষাকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবেই মানছেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও। তিনি বলেছেন, ‘একইসঙ্গে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং। তাদের সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমরা সুসম্পর্ক রাখব তাদের সঙ্গে।’

সূত্র জানায়, সবার সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে গভীরভাবেই মনোযোগী বাংলাদেশ। অতীতের ধারাবাহিকতায় নতুন বছরেও কোনো বৈশ্বিক ক্ষমতাবলয়ে জড়াতে চায় না ঢাকা। কোন দেশের সঙ্গে কার বিরোধ এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কূটনীতিতে দৃঢ় ও কৌশলী অবস্থানেই অনড় থাকতে সংকল্পবদ্ধ দেশটি। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভার্চ্যুয়াল বৈঠকেও এমন বার্তাই দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

একই সূত্র বলছে, নতুন বছরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক পথরেখা কেমন হবে, কী প্রত্যাশা দেশটির- এ নিয়ে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয় ওই বৈঠকে। বাংলাদেশের কূটনীতিতে কোন কোন বিষয় প্রাধান্য পাবে এ সম্পর্কিত গাইড লাইনও দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী ও বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিনিয়োগে বড় ভূমিকা রাখায় অব্যাহত থাকবে ম্যাচিউরড কূটনীতিক পদক্ষেপ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। এ যুদ্ধ ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছে। রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। তবে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের মিত্রতা রয়েছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গেও রাশিয়ার সম্পর্ক খুব ভালো। বৈশ্বিক রাজনীতিতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ভারসাম্যের কূটনীতি রক্ষা করে চলেছে।

তাইওয়ান, উইগুর দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তিক্ততা বেড়েই চলেছে। আর সীমান্ত সংঘাত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কেও অবনতি ঘটেছে। তবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। নতুন বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বৈশ্বিক সঙ্কটে কোনো ক্ষমতাবলয়ে জড়াতে রীতিমতো অনীহা প্রকাশ করেছে ঢাকা।

শুধু তাই নয়, ভৌগলিক রাজনীতিতে ক্রমশ ঢাকার গুরুত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ভারত ও চীনের মাঝখানে অবস্থানের কারণে উভয় পরাশক্তিই বাংলাদেশকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতেও বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশ ঘিরে প্রভাবশালী দেশগুলোর আগ্রহ কম নয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গত সোমবার (৯ জানুয়ারি) দিবাগত রাতে আফ্রিকা মহাদেশ সফরে যাওয়ার পথে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রা বিরতি করেন চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং। আনুমানিক রাত ২টার পরে এই যাত্রাবিরতিতে বিমানবন্দরে তাকে সঙ্গ দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ৫২ মিনিটের এই যাত্রাবিরতিতে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়ার পরে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনায় উঠে আসে নানা বিষয়। এর মাঝে চীনের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত প্রকল্প, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক ফোরামে একসঙ্গে কাজ করাসহ বিভিন্ন বিষয় স্থান পায় বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

একই সূত্র বলছে, চলতি মাসেই বাংলাদেশ সফর করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রতিনিধি দল। এছাড়াও, সামনের সপ্তাহেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বারবার বলেছেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখব। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতির কথা অর্থাৎ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বিদ্বেষ নয়- নীতি সফলভাবে বজায় রেখে চলেছে।’

ক’দিন আগে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ২০২৩ সালের কূটনীতির পরিকল্পনার একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশ কোনো বলয়ের মধ্যে পড়ে যায় এমন কোনো কাজ সরকার করবে না বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘বড় শক্তিগুলোর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতেও নতুন বছরে কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে সরকার। সে লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, কূটনীতি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বাংলাদেশের অর্জনগুলো বিশ্বে তুলে ধরা—দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও অপপ্রচার প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গিকারগুলো পূরণ করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২৩ সালের কূটনীতি এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’

‘২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেও বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এবং পররাষ্ট্র নীতিকে সমুন্নত রেখেই এগিয়ে যাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনীতি’-সেদিন যোগ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

কালের আলো/এমএএএমকে