বিশ্ব ইজতেমা : সম্প্রীতির মেলবন্ধন

প্রকাশিতঃ 10:43 am | January 13, 2023

মাহমুদ আহমদ

বিশ্ব মুসলমান আজ সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। নিজেদের মাঝে বিভেদ আর হানাহানির পাশাপাশি গোত্র, সম্প্রদায়কেন্দ্রিক আকিদা বিশ্বাসে হাজারও মত, চিন্তা-চেতনায় বিভক্ত বিশ্ব মুসলিম। বিভক্তি দূর করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করবে ইজতেমার বয়ান এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সু-সম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে।

তাবলিগ জামাতের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও আমরা দেখেছি। এবার আমরা আশা করব সব ভেদাভেদ ভুলে ইজতেমার ময়দান থেকে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।

প্রেম, প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। অন্যকথায়, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি বিশ্বস্ততার হক আদায়ে এবং তার সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ আচরণের মাধ্যমে এই বিশ্ব এক স্বর্গ রাজ্যে পরিণত করা। অথচ আমাদের আচার-আচরণে তা প্রকাশ পায় না।

শীতকালে দেশের আনাচে কানাচে প্রচুর ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে কষ্ট করে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ছুটে আসেন ওয়াজ শোনার জন্য। রাত জেগে খেয়ে না খেয়ে বসে অপেক্ষা করেন এমন কিছু শোনার জন্য যা শুনলে শ্রোতার জীবন নতুন করে সাজানো যায়। কিন্তু কিছু বক্তা ওয়াজ করতে গিয়ে এমনভাবে কথা বলেন যা পরিবার-পরিজন নিয়ে শোনাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

কেউ কেউ হুংকার দিয়ে আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যান। এছাড়া ওয়াজগুলোয় আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের বিষয়ে আলোকপাত না করে একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনাই যেন বেশি শোনা যায়। অথচ আগে ওয়াজ শুনে চোখ দিয়ে জল পড়তো।

আসলে প্রকৃত ইসলামের আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে সম্ভব। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।

কোনোক্রমেই এই ধারণার উদ্রেক করা ঠিক হবে না যে, ইসলাম প্রচারে তরবারি প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে না তরবারি হাতে নেওয়া হয়েছিল আর না উগ্রতা।

শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যই কেবল তরবারি ব্যবহৃত হয়েছিল, এটাই সত্য ঈমানের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে অবশ্যই এটি অর্থাৎ তরবারি কখনো ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, ঈমানি বিষয়গুলো তো মানব হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত।

ধর্মের টানে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। মক্কার প্রথম তের বছর মুসলমানদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এমনকি, মদিনায় হিজরত করার পরও শত্রুরা তাদের ওপর চড়াও হলে সম্পূর্ণ অসজ্জিত অবস্থায় থেকেও তাদের ফিরতি যুদ্ধ করতে হয়েছে। চাপ প্রয়োগে মুসলমান হলে কেউ কি এমন কোরবানি করতে পারে?

ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই।

আমরা আজ এটাই দেখছি, সুন্দর-সাবলীল ও সুগঠিত এই সব ইসলামি শিক্ষার ওপর কোনো দলই আমল করছে না। আমরা সবাই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমি যা বলি বা অনুসরণ করি তাই ঠিক। এই ধরনের মন মানসিকতা থেকে আমরা যতদিন বের হতে না পরবো ততদিন সমাজে পরিপূর্ণ শান্তি স্থাপন হতে পারে না।

আজ আমরা মহানবী ও বিশ্বনবীর (সা.) অতুলনীয় শিক্ষা ভুলে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছি বলেই সামান্য কারণে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি। এসব বিদ্বেষ কখনো কখনো এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যা প্রবল আকার ধারণ করে।

মহানবীর (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগম সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’

বায়হাকি—ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শত বিভক্ত একটি সমাজ অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।

ইসলাম ধর্মের বিধান মতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এই ধর্ম একটি সুস্পষ্ট ধর্ম। এই ধর্ম গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোনো জোর নেই, তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই করেন।

ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকতো, তাহলে মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অন্য ধর্মের মানুষদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সাথেও বন্ধু সুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে আরেক জন একমত নাও হতে পারেন, তাই বলে কি তার বিরুদ্ধে আমাকে অবস্থান নেওয়ার কোনো শিক্ষা ইসলাম আমাদের আদৌ দিয়েছে? অবশ্যই না। আমরা চাই সকল মত ও পথের অনুসারীদের সাথে সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ থেকে দেশের উন্নয়নে নিজেকে অংশীদার করতে।

লেখক: কলামিস্ট