নতুন বছর আরও সুন্দর করা যায়

প্রকাশিতঃ 11:27 am | January 18, 2023

সাইফুল হোসেন :

যদি আমি আপনাকে প্রশ্ন করি আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী? আপনি একেক সময় একেক ধরনের উত্তর দেবেন। তবে একটা বিষয় নিয়ে আমরা সবাই একমত হবো যে আমাদের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হলো ‘সময়’।

সময়কে যারা সঠিকভাবে ব্যবহার করে, তারা সফল, সার্থক ও সুখী হয়। সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার না করার কারণে, আমরা কখনও দুঃখিত, বিপন্ন বা অস্থির হই। আমরা যখন অতীতের ভুলগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করি, তখন আমরা অতীতের ভুল বা অন্যায়ভাবে করা কাজগুলো নিয়ে দুঃখিত বোধ করি। আমাদের মধ্যে অস্থিরতা ভিড় করে তখনই, যখন আমরা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করি। ভবিষ্যতের নানাবিধ ভীতির কারণে আমাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। কিন্তু যদি আমরা বর্তমানে বসবাস করি, এই বর্তমানকে যদি সুন্দর করে সাজাই, তাহলে এই বর্তমানই যখন একসময় অতীত হয়ে যাবে, তখন অতীতের জন্য আমরা দুঃখবোধ করবো না।

মোদ্দা কথা হচ্ছে আমরা অতীতে বসবাস করলে দুঃখ ছাড়া যেমন কিছু পাবো না, তেমনি ভবিষ্যতে বসবাস করলে অস্থিরতা ছাড়া আমাদের সামনে বিশেষ কিছু আসবে না। তাই আমাদের উচিত বর্তমানে বসবাস করা। কারণ, বর্তমানের সুন্দর কাজ আপনার জীবনকে সফল করবে, আলোকিত করবে, সুখী করবে। তবে অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

২০২৩ সালের জানুয়ারি চলছে। এখন আমাদের নিজের কাছে নিজের সংকল্প কী হওয়া উচিত সেটা নিয়ে কিছু কথা বলবো, যা আমাদের সবাইকে খানিকটা ভাবতে এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে সহায়তা করবে।

আপনি ২০২১ সালের শেষ দিকে যান, যখন আপনি ২০২২ সালে কী করবেন পরিকল্পনা করেছিলেন। তখন আপনি যদি ২০২২ সালের সংকল্পগুলো লিখে থাকেন, দেখবেন আপনি আপনার ২০২২ সালের যত কাজের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন, ২০২১ সালের শেষ দিকে এসে, তার মধ্যে অনেক কাজ আপনি করতে পারেননি। আবার তার মধ্যে অনেক কাজ আপনি করেছেন। আপনার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। আপনি যখন নিজের কাছে নিজে একটা সংকল্প করেছিলেন, এই সংকল্পের মধ্যে কি কোনও ভুল ছিল?

হয়তো সংকল্প আপনার সঠিক ছিল, কিন্তু এই সংকল্প যখন আপনি পালন করতে গেছেন, তখন আপনার সামনে অনেক বাধা উপস্থিত হয়েছে।

এজন্য এখন মূলত সঠিক সময় ২০২৩ সালের প্রথমেই একটা সংকল্প করা, সারাটি বছর আপনি কীভাবে সাজাবেন। তার আগে দরকার হচ্ছে গেলো বছর যে সংকল্প আপনি করতে পারেননি বা করতে পেরেছেন সেগুলোর একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা।

আমি যদি আমার কথা বলি, আমিও চিন্তা করেছিলাম ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করবো না, ঋণ থেকে বিরত থাকবো, মাসে অন্তত দুটি করে বই পড়বো। তাহলে ১২ মাসে আমার ২৪টি বই পড়া হবে। আরও সংকল্প করেছিলাম সঞ্চয় করবো, ৫০/৩০/২০ রুলস পালন করবো। আরও যা ছিল তা হলো আয়ের উৎস বের করার চেষ্টা করবো, নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হবো।

নিঃসন্দেহে আপনিও কোনও পরিকল্পনা করেছিলেন। এখন যখন মূল্যায়ন করতে বসেছেন, আপনার স্বাস্থ্যগত অবস্থা কী? ঠিক এক বছর আগে আপনার যে শারীরিক অবস্থা ছিল, তার উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি হয়েছে, আপনার সঙ্গে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কলিগ এবং আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক কেমন? সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে নাকি সম্পর্ক আরও মধুর হয়েছে। আপনার নেটওয়ার্কিংয়ের কথা যদি জিজ্ঞেস করি, এখন কি আরও বেশি নেটওয়ার্কিং হয়েছে?

অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে, অনেক পছন্দনীয় মানুষের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে? অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কি আপনার সম্পৃক্ততা বেড়েছে? আপনার আর্থিক স্বাধীনতার কথা যে চিন্তা করছেন সেদিকে কি অগ্রসর হয়েছেন? আপনার নিট সম্পদের কী অবস্থা? আগের বছর যে নিট সম্পদ ছিল সেটা বেড়েছে নাকি কমেছে? আপনার ঋণের কী অবস্থা? আপনার ঋণ কি আরও বাড়িয়েছেন নাকি যেটা ছিল সেটি পরিশোধ করে ঋণমুক্ত হয়েছেন? আপনার সামাজিক জীবনের কী অবস্থা? সমাজে আপনার অবদান চালিয়ে যাচ্ছেন নাকি কমিয়ে দিয়েছেন, নাকি আপনার কর্তব্য থেকে সরে এসেছেন?

আপনি যদি লেখক হয়ে থাকেন, তাহলে লেখালেখি করতেন। সেই লেখালেখি কি এখনও চলছে? আপনি কি এখনও মানুষের জন্য ভাবেন? আপনার আত্মিক উন্নতির কী অবস্থা? আপনি কী এখনও আগের মতো বই পড়েন? এরকম নানাবিধ প্রশ্ন যখন আপনি মূল্যায়ন করবেন, এই মূল্যায়ন করবেন সাধারণত নিজের সঙ্গে, অন্য কারও সঙ্গে নয়। নিজের সঙ্গে মূল্যায়ন করার পর দেখবেন আপনার অনেক কিছু করার ছিল, যা করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা-ই হয়।

আপনি ঠিক করুন, ২০২৩ সালের জন্য কী কী করবেন? আপনার যেসব জায়গায় উন্নতি হওয়ার কথা ছিল সেসব জায়গায় উন্নতি কেন হয়নি, সেটি খুঁজে বের করুন। ২০২৩ সালের জন্য সর্বোচ্চ পরিকল্পনা, শ্রম এবং মেধা দিয়ে আপনি সেই কাজগুলো যেন করতে পারেন, সেজন্য প্রস্তুতি নিন।

সবচেয়ে বড় কথা, নিজের কাছে যখন প্রতিজ্ঞা করছেন তখন আপনি আপনার কাছে দায়বদ্ধ, অন্য কারও কাছে নয়। আপনি প্রত্যেক দিন অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুন। নিজের বেস্ট ভার্সন হওয়ার চেষ্টা করুন। যখন আমি নিজের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সব আমি পালন করতে পারিনি। কিন্তু অনেকটা আমি পালন করতে পেরেছি। আমি আমার আয়ের উৎস বাড়িয়েছি, আমার বিজনেসের নতুন উইং শুরু করেছি গবেষণার। আমাদের নেটওয়ার্কিং আরও বেড়েছে। তখন দুটি কোম্পানির সঙ্গে আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করতাম, এখন ৫টি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছি। তবে আমার পত্রিকায় লেখা কমেছে, ব্যস্ততার কারণে। এটা হচ্ছে আমার ব্যাপার। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা কী সেটা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করুন। মূল্যায়ন করে আপনার ২০২৩ সালের জন্য নিজের সমাধানগুলো ঠিক করে নিন। আমি আপনাকে একটু সহায়তা করতে পারি কোন দিকগুলো নিয়ে কাজ করবেন।

প্রথমত, আপনি আপনার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। স্বাস্থ্য হচ্ছে আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অনেক অসুখ-বিসুখ যদি আপনার মধ্যে ভিড় করে, তাহলে আপনি কোনও কিছুই সঠিকভাবে করতে পারবেন না। তাই নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, ডায়েটিং, জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলা, জীবন্ত খাবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া– এসব বিষয় মেনে চলবেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা-ই মূলত করবেন এবং সেটা প্রতিদিন করবেন।

আমরা জানি, ৫০ বছর আগে মানুষ যে পরিমাণ খাবার খেতো, এখন তার দ্বিগুণ খাবার খায়। যেটা তার জন্য দরকার না। এবং এই খাবারের যে বিষক্রিয়া বা ভেজাল আছে, তার জন্য আমাদের অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছে। সেজন্য প্রথমে স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখাটা জরুরি। আমরা অর্থ আয় করতে গিয়ে স্বাস্থ্য খারাপ করে ফেলি, কিন্তু সেই অর্থ দিয়ে আমরা স্বাস্থ্যকে ঠিক করতে পারি না– এটা ধ্রুব সত্য।

দ্বিতীয়ত, আপনি পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করুন। পারিবারিক বন্ধন বলতে মূলত আপনার পার্টনারের সঙ্গে সম্পর্ক, বাচ্চাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক- এগুলো খুব মজবুত করা দরকার। কারণ, মূলত আমরা সামাজিক জীব। সমাজের প্রথম যে ইউনিট সেটা হলো পরিবার। এই পরিবারের সবার সঙ্গে যদি আপনার সুসম্পর্ক না থাকে এবং একটা দৃঢ় বন্ধন না থাকে তাহলে সামনে এগোনো খুব কঠিন হয়ে যায়।

আপনার স্ত্রী অথবা স্বামী, বাচ্চা, ভাইবোন, নিকট আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কি অবস্থা? যদি সম্পর্ক কোথাও খারাপ থাকে সেটা ঠিক করুন এবং এটি আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না। আপনাকে উদ্যোগী হয়ে করতে হবে। সম্পর্ক যদি ঠিক থাকে দেখবেন আপনি অনেক দিক থেকে সুবিধা পাচ্ছেন। আপনার মনে বল থাকছে, আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, সমাজে আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। সবাই আপনাকে ভালোবাসছে। সম্পর্ক তৈরি এবং রক্ষা করা খুব জরুরি। আমরা গতানুগতিক কিছু সম্পর্ক পেয়ে যাই। কিন্তু চর্চার অভাবে সেই সম্পর্কগুলো নষ্ট হতে থাকে, এবং মানুষ আপনার কাছ থেকে দূরে সরতে থাকে। এদিকে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে।

তৃতীয়ত, আপনার আর্থিক উন্নতি। ধরুন আপনি একটা চাকরি করেন। ফিক্সড একটা বেতন পান। সেখানে আপনার সুযোগ আছে বেতনকে বাড়ানোর। তাছাড়া আপনার যোগ্যতা, আপনার অন্যান্য গুণ- এগুলো কাজে লাগিয়ে আরও নতুন আয়ের উৎস তৈরি করতে পারেন। সেদিকে আপনি নজর দিন। কারণ, আর্থিক স্বাধীনতার জন্য আপনার আয় বাড়ানো দরকার। আপনারা জানেন, ২০২৩ সাল নিয়ে আমরা সবাই শঙ্কায় আছি। কেউ কেউ দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না থামে তাহলে সেদিকে পৃথিবী যাবে। সেজন্য আমাদের সুরক্ষা কীভাবে করবো সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এবং আলস্য বাদ দিয়ে মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম কাজে লাগিয়ে আমাদের আয়ের উৎস বাড়াতে হবে। কারও যদি একটা আয়ের উৎস থাকে তাহলে দুইটা আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে খরচের লাগাম একটু টেনে ধরি। কারণ, আপনি আয়ও বাড়ালেন সঙ্গে খরচও বাড়ালেন, পরিণামে আপনার লাভ হলো না। আপনার সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যতদূর সম্ভব আয় করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে পরিবারের অন্যদের আয়ের উৎসের সঙ্গে সংযুক্ত করুন, অনুপ্রাণিত করুন।

আর্থিক উন্নতির জন্য আরও কিছু বিষয় আছে। সেটা হচ্ছে বাজেটিং করুন। খরচ ও সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করুন। অযাচিত খরচ বাদ দিতে শিখুন। আপনার প্রয়োজনীয় বস্তুর প্রতি বেশি খেয়াল দিন, কম প্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে দূরে থাকুন। কারণ, সময় যখন খারাপ যায়, তখন প্রয়োজনীয় বস্তুর প্রতি বেশি খেয়াল রাখতে হয়। আপনার দরকার সার্বিক আর্থিক উন্নতি। যদি সচেতন থাকেন, দেখবেন আয় কমছে না, বরং বাড়ছে। তবে একটা কথা বলে রাখি, মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। কারণ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব আপনার আসল আয় কমিয়ে দেয়। এজন্য আপনার আয়ের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে।

চতুর্থত, আত্ম-উন্নয়ন। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, অভিজ্ঞতা হয়েছে কিন্তু নতুন কোনও জ্ঞান ইচ্ছে করে কেউ অর্জন করেননি বা করলেও যারা করেছেন তাদের সংখ্যা খুব কম। শুধু বয়স বাড়লেই হবে না, এর সঙ্গে সক্ষমতা, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও জ্ঞানের পরিধি বাড়তে হবে। এখন এই তথ্যের যুগে মূলত যদি প্রতি মুহূর্তে নিজের উন্নতি না হয়, তাহলে একসময় আপনি প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়বেন। প্রত্যেকটা মানুষ সামনে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। এবং জ্ঞান এত সহজলভ্য যে সবকিছু আপনার মুঠোফোনেই রয়েছে। আপনি চাইলেই সেখান থেকে নিতে পারেন। আপনি বিনামূল্যে অসংখ্য কোর্স করতে পারেন বা টাকা দিয়ে অনেক জায়গায় প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। ফলে নিজের উন্নতি এটা শুধু আপনার ইচ্ছার ব্যাপার। আপনি নিজেকে কোথায় নিতে চান সেজন্য তৈরি হতে হবে। প্রতি মুহূর্তে ছোট-বড় সবার কাছে শিখতে হবে। শিখে নিজের উন্নয়ন করতে হবে। এটাকে বলছি আত্ম-উন্নয়ন। এই জ্ঞানের ভিত্তি যত বাড়াবেন, সমাজে তত মানসম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারবেন। চেষ্টা করবেন ২০২৩ সালে যেন আপনার প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।

পঞ্চমত, আপনার আত্মিক উন্নতি। আপনি আপনার মূল্যবোধের উন্নয়ন করতে পারছেন কিনা। আপনি আপনার প্রার্থনার শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন কিনা। আপনি শুধু খেয়াল করুন গত বছর এই শক্তিগুলো কাজে লাগিয়েছেন কিনা। যদি না করে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই অনুভব করছেন এই বিষয়গুলোতে খেয়াল করা দরকার। এটা যেন আপনার আত্মার উন্নয়নভিত্তিক হয়।

আপনার মধ্যে যেন সেই শক্তি, মূল্যবোধ জন্মায় যা আপনাকে মানুষের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ, সমাজ এবং দেশের প্রতি যে দায়িত্ববোধ আছে সেটা পালন করতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই শক্তিকে ভিতরে ধারণ করা খুব জরুরি। সে জন্য আপনার স্থির সময় দরকার, আপনার চিন্তার সময় দরকার।

আপনি আপনার আত্মিক উন্নতির জন্য কাজ করবেন। দেখা যাবে, সেটা আপনার প্রশান্তি এনে দেবে, আপনার জীবনে মূল্য সংযোজন করে দেবে। সেটা আপনার মানুষের সাথে সম্পর্কে যেমন সাহায্য করবে, নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়াতেও দারুণভাবে কাজে লাগবে।

ষষ্ঠত, আপনার প্যাশন ভিত্তিক কাজের উন্নয়ন। যেমন ধরুন, আমি লিখতে পছন্দ করি, আমি বলতে পছন্দ করি। আমি যে কাজ করছি তার সাথে ২ টারই সম্পর্ক আছে। আমার কথা বলতে হয়, আমার প্রচুর লিখতে হয়। আমার আরও কিছু ভাল লাগার জায়গা আছে, সব প্যাশনকে কাজে এতটা সহজ নয়। আপনিও খুঁজে দেখুন আপনার অনেক কাজের প্রতি গভীর প্যাশন আছে, আপনি সেটার উপর কাজ করছেন কিনা। কারণ প্যাশন যখন পেশার সাথে মিলে যায় তখন আপনি অদম্য হয়ে ওঠেন, তখন আপনাকে দমিয়ে রাখার আর কেউ থাকে না। আপনি একটু খেয়াল করুণ আপনার আসলে প্যাশনের সাথে পেশা মিলছে কিনা বা আপনি আপনার প্যাশন অনুধাবন করতে পারছেন কিনা। অনেক ক্ষেত্রে প্যাশনের সাথে আমাদের পেশা মিলে না। তার মানে এই না যে হতাশ হয়ে পড়তে হবে। আপনার হাতে অনেক সময় থাকে চাইলেই আপনি আপনার প্যাশনকে অনুধাবন করতে পারবেন। অনেকের গান গেতে ভালো লাগে, অনেকের আবার ছবি আঁকতে ভালো লাগে, অনেকের গিটার বাজাতে ভালো লাগে, অনেকের আবার শুধু বই পড়তে ভালো লাগে। যদি আপনি চাকরি করেন, ৯-৬ টা অফিস করেন, আপনার হাতে অফুরন্ত সময় থাকে। সেই সময়টার মধ্যে আপনি আপনার প্যাশনকে কাজে লাগান। কারণ আপনি যদি প্যাশনকে কাজে লাগাতে না পারেন তাহলে আপনার মনের ভেতরে সারাক্ষণ একটা অশান্তি কাজ করবে।

আপনি একটা অতৃপ্তিতে ভুগবেন। যেমন আমি গান গেতে পছন্দ করি, গান লিখতে পছন্দ করি। যখন আমি গান গাই তখন আমি খুব ভাল বোধ করি। এটা অন্যের জন্য নয়,নিজের জন্যে। প্যাশন কিন্তু আপনার, তাই বলে যারা প্যাশনের সাথে নিজেকে মিলাতে পারবেন না তারা দুঃখিত হবেন না। কারণ পেশা যেটা সেটা আমাদের জীবিকাকে ঠিক রাখার জন্যে, আমাদের জীবন চলার জন্যে লাগে। আপনি দেখেন আপনি ২০২৩ সালে কি করবেন? আপনি একটু লিখে ফেলুন ২০২৩ সালে আপনার যে প্যাশনগুলো আছে সেটার জন্যে আপনি কতটুকু সময় ব্যয় করবেন এবং কি পরিমাণে কাজ করবেন।

সপ্তমত হচ্ছে, আপনার সামাজিক দায়িত্ববোধ। আমরা যেহেতু সামাজিক মানুষ, আমাদের সমাজের প্রতি কিছু দায়িত্ববোধ আছে। আমাদের মধ্যে যে ধনী আছে, সে পারে তার সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়ে গরিবদের সাহায্য করতে। আমাদের মধ্যে যিনি জ্ঞানী হয়ত টাকা নেই তার কিন্তু তিনি পারেন তার জ্ঞানকে সমাজের কাজে লাগাতে। এভাবে যার যতটুকু সক্ষমতা আছে, সমাজের জন্য তার কাজ করা দরকার। কাজ করলে সমাজ এগিয়ে যাবে, আপনার অবদান বাড়বে, আপনাকে মানুষ মনে রাখবে। আর সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে, আপনার ভাল লাগবে এই ভেবে যে আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন মানুষের জন্য কিছু করার । চিন্তা করলে আপনি খুঁজে পাবেন আপনি শুধু আপনার নন, আপনি শুধু আপনার পরিবারের নন, আপনি কিন্তু এই সমাজের একজন। যতটুকু সম্ভব মানুষের ক্ষতি না করে, মানুষের কাজে লাগুন।

অষ্টমত, মানুষ মূলত ৫৫ থেকে ৬০ বছর কখনও ৬৫ বছর পর্যন্ত কাজ করে। পরে তার আর কাজ করার শক্তি থাকে না, অসুস্থ হয়ে যায় অনেকে বা কাজ করার শক্তি থাকলেও কাজ করার সুযোগ পান না। দেখা যায় ৬০-৬৫ বছর পরে মানুষ আর আয় করতে পারে না। এইজন্য যে সময়টা আপনি আয় করে, সে সময় তার একটা অংশকে কে বাঁচিয়ে রেখে রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান করতে হয় এবং রিটায়ার্ড লাইফে যেন চলতে পারেন সেইজন্য ব্যবস্থা করতে হয়। আপনি যেই বয়সের হোন না কেন, আপনি ভেবে দেখেন যে আপনার রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান কি? রিটায়ারমেন্টের পরে আপনি কিভাবে চলবেন? আপনি কি আপনার বাচ্চাদের উপরে মানে সন্তান সন্ততির উপরে বা আত্মীয়স্বজনের উপরে নির্ভর করবেন নাকি আপনার এখনকার অর্জিত টাকা একটা অংশ সঞ্চয় করে বা বিনিয়োগ করে, যে টাকা আসবে সেই টাকা দিয়ে রিটায়ারমেন্টের সময়ে চলবেন। এই প্ল্যান যদি আপনি না করে থাকেন তাহলে আজই শুরু করুন, আর যদি আপনি করে থাকেন তাহলে যে প্ল্যানটা করেছেন, সেটাকে চালিয়ে যান। আপনি চিন্তা করে দেখুন ২০২৩ সালে রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান আপনার কি কি কাজ করণীয় আছে। এক এক জনের এক এক রকম থাকবে আপনি সেভাবে চিন্তা করে সামনে অগ্রসর হবেন।

নবমত, যে কাজ টা করতে হবে সেটা হচ্ছে, আপনি এক বছরের জন্য যে পরিকল্পনা করেছেন, সেই পরিকল্পনাকে আপনার ভেঙ্গে ফেলতে হবে ছোট ছোট করে ১২ টি ভাগে। এই, জানুয়ারিতে আপনি কি করবেন, ফেব্রুয়ারীতে আপনি কি করবেন, মার্চে আপনি কি করবেন, এই করতে করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ভেঙে ফেললে আপনার সুবিধাটা হচ্ছে আপনার অর্জনটা সহজ হয়ে যাবে। তাহলে এটা আপনার প্রতি মাসে ভাগ করে ফেলতে হবে। ভাগ করে আপনার পরিশ্রম করতে হবে। আপনার স্ট্র্যাটেজি ফিক্সড করে আপনার কাজে নামতে হবে। তারপরে আপনি ধীরে ধীরে উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাবেন।

শুধু এটা আর্থিক বিষয়ে নয়। এটা স্বাস্থ্যর ক্ষেত্রে, সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি জীবনের সব ক্ষেত্রে। আপনি আপনার চাকরি প্রমোশন চান সেজন্য কাজ করতে হবে। আমরা লম্বা সময়ের একটা প্ল্যান তৈরি করি এবং অপরিকল্পিতভাবে সামনে যাই। লক্ষ্য অর্জিত না হলে মনে করি যে, সামনের দিকে এটা ঠিক করব। প্রথম মাসে পারলাম না কি হয়েছে দ্বিতীয় মাসে ঠিকই করবো।

উচিত হচ্ছে প্রতিমাসে আপনি আপনার অবস্থান কি হচ্ছে সেটা মূল্যায়ন করুন। এমন কি প্রতি সপ্তাহে যদি অবস্থা কি হচ্ছে সেটা মূল্যায়ন করা যায় তাহলে আরও ভালো। এইভাবে আপনি আপনার ২০২৩ সালের জন্য একটা পরিকল্পনা সেট করুন। ২০২৩ সালে আপনার নিজের কাছে নিজের একটা কমিটমেন্ট করুন। এবং এই কমিটমেন্টগুলো লিখে ফেলুন। লিখে ফেললে তাহলে কোনদিকে আপনি যাবেন, কোন ডাইরেকশনে যাচ্ছেন, এটা প্রত্যেক মাসে মাসে, পারলে বলেছি যে, প্রতি সপ্তাহে এটার মূল্যায়ন করুন। মূলকথা হচ্ছে আপনি আপনার বেস্ট ভার্সন হওয়ার চেষ্টা করুন প্রতি মুহূর্তে। তাহলে দেখবেন একসময় আপনি যা চেয়েছিলেন সেখানে পৌঁছে গেছেন। যেমনটি হতে চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি হয়েছেন। নতুন বছর সবার জন্য শুভ হোক।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট