যে কারণে সোনার বাংলা সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে
প্রকাশিতঃ 10:35 am | January 22, 2023
মাহমুদ আহমদ :
১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের আগ্রাসী থাবা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে সদ্য জন্ম নেওয়া দেশটি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো। ঘরে ঘরে শোকের মাতম বইছে আর অপরদিকে রাস্তাঘাট, রেলপথসহ অবকাঠামো নষ্ট হয়ে সে যেন এক ধ্বংসস্তূপের বাংলাদেশ। ব্যাংক ও শিল্প খাতেরও একই অবস্থা।
অর্থাৎ সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। এমনই এক চ্যালেঞ্জ সামনে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মাত্র অর্ধশত বছরে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে এক মডেল হিসেবে পরিচিত। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হলে বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও মেট্রোরেলের ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এমনকি দেশটির মানুষ মেট্রোরেলের ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে তাদের নেতাদের গালিগালাজ করছেন এবং বলছেন এটি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি ‘১৬ ডিসেম্বর’।
আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল কারণই হলো এদেশে ধর্মান্ধদের মাথায় তোলা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও যেন না হয় সেই প্রত্যাশা আমাদের। বাংলাদেশ সরকার যদিও জঙ্গি দমনে কঠোর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারপরেও মনে করি এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। আজ আমরা কেউ বলতে পারি না যে, আমরা নিরাপদ।
অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক তফাৎ দেখা যায়। বাংলাদেশকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল যে দেশটি, এখন অনেক কিছুতেই তারা পিছিয়ে। গত ৫২ বছরের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক জাইঘাম খান বাংলাদেশের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি ইমরান খানের প্রতিশ্রুতি পূরণের দরকার নেই মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদো।’
অর্থাৎ আল্লাহর দোহাই লাগে আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। এছাড়া পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানই বাংলাদেশের উন্নতির তুলনা করে বড় আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন-পূর্ব পাকিস্তান যখন পৃথক হলো তখন অনেককে বলতে শুনেছি, আমাদের ওপর একটি বোঝা হিসেবে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, পৃথক হওয়ায় ভালোই হয়েছে। এসব কথা আমি নিজ কানে শুনেছি। আজ সেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। এর কারণ হলো, সেখানের নীতিনির্ধারকরা দূরদর্শী।
মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে প্রশংসার ঝড় বইছে পাকিস্তানের মিডিয়ায়। একজন পাকিস্তানি ইউটিউবার বলেছেন, ‘যে দেশকে আমরা দুই টাকার দেশ হিসেবে ভাবতাম, তারা আজ মেট্রোরেল চালু করেছে। যে দেশকে হেনরি কিসিঞ্জার বলছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতু তৈরি করেছে, তা আপনাদের অবশ্যই মনে আছে। হেনরি কিসিঞ্জার এখন কই?’
বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছেন পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আমাদের দেশে এক্সপোর্ট হয় সবচেয়ে বেশি টেক্সটাইল বিভাগ থেকে। টেক্সটাইলের বিষয়টি দেখুন, এমন একটি দেশ, কোন এক যুগে টেক্সটাইলে যে দেশ আমাদের চেয়ে অনেক পেছনে ছিল, তারা এখন আমাদের চেয়ে বহুগুণ অগ্রসর হয়ে গেছে।
এটি কোন দেশ? আর সে দেশে কি টেক্সটাইলের কাঁচামাল আছে? দেখুন! সেখানে হয়তো কাঁচামাল আছে, তবে সে দেশে কার্পাস তুলার একটি চারাগাছও জন্মায় না। সে দেশের নাম হলো, বাংলাদেশ। বাংলাদেশ টেক্সটাইলের দিক থেকে আমাদের দেশের তুলনায় কেবল সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে তাই নয় বরং আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর হয়েছে।
বাংলাদেশের এই যে উন্নতি, অগ্রগতি এর কারণ কি? এর মূল কারণ হলো, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তার ধর্মকর্ম পালন করতে পারে। শুরু থেকেই এদেশ ছিল ধর্মান্ধ উগ্রমোল্লাবিরোধী। অপরদিকে পাকিস্তান নামক দেশটিতে ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রভাব ও দাপটে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে উগ্রতা; যার ফলে আজ এই উগ্রধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের সাধারণ নিরীহ মানুষ থেকে নিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন জিম্মি হয়ে আছে। প্রতিদিন ধর্মান্ধদের হাতে সেখানে মানুষ মারা পড়ছে।
আজ পাকিস্তানের পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স, স্কুল, মসজিদ, অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় এবং সেনানিবাসগুলোও ধর্মান্ধদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়। ধর্মের নামে অধর্মের নজিরবিহীন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত পাকিস্তানে ঘটেই চলেছে। মৌলবাদী এ দেশটিতে ধর্মের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫৩/৫৪ সালে তারা এ দেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর বার বার আক্রমণ চালিয়ে সহস্রাধিক সদস্যকে হত্যা করেছে। ব্লাসফেমি আইনের আওতায় এনে হত্যা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানে যদিও প্রতিনিয়ত শিয়া, সুন্নি আক্রান্ত হচ্ছে, হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে, তথাপি আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে এসব নির্যাতনের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আহমদিদের বিরুদ্ধে সেই দেশে এমন সব আইন পাস করা বা প্রণয়ন করা হয়েছে, যেগুলো আহমদিয়া নির্যাতনকে এক ধরনের পৃষ্ঠ-পোষকতা জোগায়। এরই সুযোগে এবং ছত্রছায়ায় সেখানে যুগ যুগ ধরে আহমদিয়ারা বার বার আক্রান্ত হচ্ছে।
আবার এই ছত্রছায়ায় সেখানে উগ্র-ধর্মান্ধদের ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানে একজন আহমদি মসজিদকে মসজিদ বলতে পারে না, নামাজের জন্য আজান দিতে পারে না। নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ শব্দ ব্যবহার করতে পারে না। নিজেকে মুসলমান হিসেবে প্রকাশ করতে পারে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি কেউ এসব কাজ করে তাহলে তার জন্য তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের দণ্ড রাখা হয়েছে।
আজ এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের সাধারণ নিরীহ মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জিম্মি হয়ে আছে। তাই দেখা যাচ্ছে, যে বিষয়টিকে (অর্থাৎ আহমদি তথা কাদিয়ানি) উগ্র মৌলবাদীরা সমস্যার সমাধান বলেছিল সেটা প্রকৃতপক্ষে সমাধান ছিল না বরং তা ছিল উগ্রধর্মান্ধদের সমাজে অনুপ্রবেশের ওপেন লাইসেন্স। যার ফলে পাকিস্তান আজ আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। আল কায়েদা, তালেবানসহ সব জঙ্গির আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দেশটি। আল কায়েদাপ্রধান লাদেনের অবস্থানও ছিল এ দেশটিতে। এখনও দেশটির কিছু এলাকা তালেবান নিয়ন্ত্রিত।
উগ্রধর্মান্ধদের মাথায় তুলে পাকিস্তান আজ সন্ত্রাসী জন্মদানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে আর অপরদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যে উন্নতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক বেশি।
আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল কারণই হলো এদেশে ধর্মান্ধদের মাথায় তোলা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও যেন না হয় সেই প্রত্যাশা আমাদের। বাংলাদেশ সরকার যদিও জঙ্গি দমনে কঠোর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারপরও মনে করি এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। আজ আমরা কেউ বলতে পারি না যে, আমরা নিরাপদ।
তাই সব সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ ধর্মান্ধদের নেই কোনো ধর্ম, নেই বিবেক। শেষে এ কথাই বলব, বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্মান্ধদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। ধর্মান্ধদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।