প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতায় তুরস্কের দু:সময়ের ‘বন্ধু’ বাংলাদেশ; সাফল্যের আখরে আলোকোজ্জ্বল বীর সেনারা

প্রকাশিতঃ 10:32 am | February 22, 2023

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

শুধু দেশেই নয় বিদেশের মাটিতেও দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। ক’দিন আগেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ তুরস্কে বাংলাদেশের উদ্ধারকারী দলের নেতৃত্ব দেওয়া বীর সেনাদের প্রশংসা করে এমনটিই বলেছিলেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভূমিকম্পের পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে দেশটিতে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম দেশটির অচিন্তনীয় বিপদে বাংলাদেশ যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে তাতে রীতিমতো অবাক গোটা বিশ্ব! বাংলাদেশ শুধু সহায়তাই পাঠায়নি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ৬০ সদস্যের একটি সম্মিলিত উদ্ধারকারী দলও পাঠায় সেখানে।

দু’দফায় খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রী পাঠানোর পাশাপাশি একদিনের রাষ্ট্রীয় শোকও পালন করেছে বাংলাদেশ। বিপদের দিনে আন্তরিকভাবে এমন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি গভীরভাবেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বন্ধুপ্রতীম দেশটি। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত ও মৃতদের উদ্ধারের পাশাপাশি আবেগ ও মানবিকতার সঙ্গে দেশটির সাধারণ মানুষের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা কেবল নজরকাড়াই নয় মুগ্ধতার শৌর্য-বীর্য আর বীরত্বের বহি:প্রকাশও ঘটিয়েছে যেন!

অকুতোভয় সম্মিলিত দল সেখানকার মানুষকে শুনিয়েছেন সাহসের বাণী ও বরাভয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় শুদ্ধ, সাহসী ও নির্লোভ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সম্মিলিত দলের প্রতিটি সদস্য বিপদে ও সঙ্কটে তাদের দেখিয়েছেন পথ, মানবতার জয়গানে স্পর্শ দিয়েছেন সাহসের। নিজেদের নি:শ্বাসের মতোই সবার ঊর্ধ্বে মানবিকতাকেই মুখ্য উপজীব্য করে তুরস্কের সাধারণ মানুষের হৃদয়গ্রোথিত আবেগ, শ্রদ্ধা আর গভীর ভালোবাসার সঙ্গে অর্জন করেছেন অভূতপূর্ব সম্মান। তুরস্কের প্রশাসনিক পর্যায়েও বাংলাদেশের উদ্ধারকারী দলের কার্যক্রম হয়েছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সাফল্যের আখরে উঠে এসেছে বীর সেনাদের মানবতা ও মনুষ্যত্বে রাঙানো বিশাল ক্যানভাস।

প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে দেশটিতে টানা ১০ দিনের সফল উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮ টায় দেশে ফিরেছে ৬০ সদস্যের সম্মিলিত উদ্ধারকারী দল। দলটিতে এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ২৪, মেডিকেল কোরের চিকিৎসক ১০, ফায়ার সার্ভিসের ১২ ও বিমান বাহিনীর ক্রু ১৪ জন ছিলেন। এদিন রাত ৮ টায় বিমান বাহিনীর বিমানে তেজগাঁওয় বিমান ঘাঁটিতে এসে পৌঁছান তাঁরা। এ সময় বিমান বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ এইচ এম ফজলুল হক তাদের হৃদয়ের উষ্ণতায় বরণ করেন। তিনি দেশটির দুর্যোগে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকায় ধন্যবাদ জানান।

জানা যায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানে ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আক্রান্ত এলাকার ঘরবাড়ি। হতাহত হন লাখো মানুষ। ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন তুরস্কে উদ্ধারকারী দল পাঠানোর। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার কাজে অংশ নিতে যান বাংলাদেশের ৬০ সদস্যের একটি সম্মিলিত দল। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের দেশে ফিরে আসার কথা ছিল। তবে তুরস্ক সরকারের অনুরাধে বাড়ানো হয় উদ্ধার অভিযানের মেয়াদ। গত সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাতে আদানা বিমানবন্দর থেকে বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে করে উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা বাংলাদেশের পথে যাত্রা করেন।ভূমিকম্পে তুরস্কে এখন পর্যন্ত ৪১ হাজার মানুষের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাংলাদেশ উদ্ধারকারী দল দৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে উদ্ধার তৎপরতা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে বীরের বেশেই দেশে ফিরে আসার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি তুরস্ক সরকারের আস্থাকে আরও সমুন্নত করেছে। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ’র গাইডলাইনে জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েই মানবতার সেবায় বিদেশের মাটিতেও সুচারুভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেদের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবেই উজ্জ্বল করেছেন। এই ১০ দিনে তুরস্কের নাগরিকদের কাছে দু:সময়ে ভরসার আরেক নাম হয়ে উঠে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বাইরে প্রথমবারের মতো শক্তিশালী ও উন্নত দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্যোগে পাশে দাঁড়িয়ে নতুন ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন নিজেদের।

বাংলাদেশের সম্মিলিত উদ্ধারকারী দলের দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা বলেন উদ্ধারকারী দলনেতা সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রুহুল আমিন। তুরস্কের দু:সময়ে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ হিসেবে নিজেদের উদ্ধার অভিযানের সাফল্যময় সমাপ্তিতে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। এতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে বলেও মত দেন তিনি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা পুরো উদ্ধারকারী দল এখান থেকে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিয়ে এসেছি, আমরা বিশ্বাস করি এবং আমরা আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় গেলে আমরা আরও কার্যকর অবদান রাখতে পারবো।’

সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের অপারেশন্স ও পরিকল্পনা পরিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ মাসীহুর রহমান বলেন, ‘উদ্ধারকারী দল অত্যন্ত সুচারুরূপে দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করেন ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে তুরস্কে যাওয়ার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মহোদয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরকম অপারেশনের মাধ্যমে একদিকে আমাদের যেমন প্রস্তুতি হচ্ছে অন্যদিকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমাদের উন্নত পররাষ্ট্রনীতির যে অ্যাপ্লিকেশন আছে সেই বিষয়টিও সুন্দরভাবে প্রতিভাত হচ্ছে।’

সেনা সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশন্স’র পরিচালক (ডিএমও) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফেরদৌস হাসান সেলিম বলেন, ‘সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ’র তাৎক্ষনিক নির্দেশনায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো.রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ২৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ উদ্ধারকারী দল ও মেডিকেল কোরের ১০ সদ্যসের একটি চিকিৎসক দল, ফায়ার সার্ভিসের ১২ সদস্যের একটি স্পেশালাইজড দল প্রয়োজনীয় উদ্ধার, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ওষুধসহ দ্রুত তুরস্কে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’

তিনি বলেন, ‘মাননীয় সেনাবাহিনী প্রধানের তাৎক্ষনিক নির্দেশে ৮ ফেব্রুয়ারি দলটি প্রস্তুত হয়ে যায় এবং বিমানবাহিনীর পরিবহন বিমানযোগে তাদের তুরস্কে প্রেরণ করা হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আদিয়ামান শহরে উদ্ধার অভিযানে নিয়োজিত ছিল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দলটিকে তাদের পারফরম্যান্সের কারণে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী হাতাই শহরে নিয়োজিত করা হয়। আমাদের সদস্যদের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ তুরস্ক সরকার ছাড়াও বহুজাতিক বাহিনী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভূয়সীভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এ ধরণের বিশেষায়িত অপারেশনে কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রদর্শনের পাশাপাশি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সম্মানকে অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফেরদৌস হাসান সেলিম আরও বলেন, ‘স্বল্পতম সময়ে এ ধরণের একটি সম্মিলিত দলকে মোতায়েন করা এবং দায়িত্বপালনের মাধ্যমে এ দল যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা আমাদের সক্ষমতাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। এ জাতীয় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে আরও কার্যকরীভাবে দায়িত্ব পালনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে