প্রাণের মূল্য থাকলে আগুনের প্রতিকার নিয়ে ভাবা হতো
প্রকাশিতঃ 11:07 am | February 23, 2023
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :
রাজধানীর অভিজাতপাড়া গুলশানের আলিশান বহুতল ভবনটিতে আগুন লাগার ঘটনায় দুজন প্রাণ হারিয়েছেন। বেশ কয়েকজনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। এই শহরে এত বেশি আগুন লাগে যে এখন এমন ঘটনায় নিন্দাবাক্যও স্তব্ধ হয়ে আসে। একটি করে ঘটনা ঘটে আর এসব দুর্ঘটনার পশ্চাতে কত স্তরের কত দফতরের ব্যর্থতা আছে ভাবলে মস্তিষ্ক অবশ হয় ঠিকই, কিন্তু প্রতিকার হয় না।
অন্য দুর্ঘটনার চেয়ে এর প্রকৃতি আলাদা। এটি বড় লোকের বিল্ডিং, বড় লোকের বাস। ব্যবস্থাপনার কমতিও ছিল না। রাজউক কর্মকর্তারা এ ভবন নির্মাণে কোনও অনিয়ম পাননি এবং আগুন লাগার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্ক সংকেতও বেজে উঠেছিল বলে জানা গেলো। কিন্তু ভবনে থাকা বেশিরভাগ পরিবার শুরুতে প্রথমে সেটি আমলে নেয়নি। জরুরি নির্গমন সিঁড়ি থাকলেও সেটি তারা ব্যবহার করেননি। যে ফ্লোর থেকে আগুন লেগেছে, দমকল বাহিনীর কর্তারা বলছেন সেখানে আগুন লাগার সব ব্যবস্থাই ছিল। যেমন, গ্যাসের পয়েন্ট যেখানে তার পাশেই আছে বিদ্যুতের পয়েন্টও। এর পাশাপাশি ছিল প্রচুর দাহ্যবস্তু।
এগুলো সবই আমাদের উদাসীনতা। আজ একটি ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে, তাই আলোচনা এখন তুঙ্গে। আরেকটি ঘটনা এসে গুলশান ঘটনার বেদনাকে বহুদূর নিয়ে যাবে। কত প্রাণ যায়, কত কিছু পুড়ে যায়, কিন্তু দায়িত্বহীনতার অবসান হয় না।
আগুন লাগার আয়োজন সবখানে বিরাজমান। পুরোনো ঢাকায় একর পর এক আগুন লাগে, বহু মানুষের মৃত্যু হয়, কত পরিবার আজীবনের জন্য সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, কত সম্পদ ছাই হয়ে যায়, কিন্তু কেমিক্যালের গুদাম সরানো হয় না। সাধারণ আবাসিক বা অনাবাসিক এলাকা তো দূরের কথা, বনানী, গুলশানে আগেও বড় কয়েকটি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এরপরও অগ্নিনির্বাপণসহ সুরক্ষার নানাবিধ আবশ্যক ব্যবস্থার কোনও কিছুই চোখে পড়ে না। এর কারণ, এ দেশে মানুষের প্রাণের মূল্য বড়ই কম। আগুনে প্রাণ গেলে দুই-একদিন হইচই হয়ে থাকে, তারপর আরেকটি ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত সব কর্তৃপক্ষ চুপ করেই থাকে। এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দোষ চাপায়, বড় বড় বিবৃতি আসে, হুমকি ধমকি আসে, টেলিভিশনের সামনে এসে কিছু কথা বলেন মেয়রসহ বড় কর্তারা। অতঃপর নতুন সংকট আবির্ভূত হয়, মৃতদের কথা সবাই ভুলে যায়। বস্তি বা পুরোনো ঢাকায় হলে গরিব মানুষের হাতে কিছু টাকা তুলে দিলেই যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে করা হয়। এতে তারা নিজেদের মহানুভবতার প্রচার করতে পারেন ঠিকই, কারণ এর চেয়ে সহজ ও কার্যকর ব্যবস্থা বলে আর কিছু তারা ভাবতে পারেন না।
সেই কবে থেকে শুনছি যে ফায়ার সার্ভিসকে শক্তিশালী করা হয়েছে, আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এবারের গুলশানের ঘটনায় সেই পুরো কথাই ফের উঠে আসছে যে সত্যিকারের সক্ষমতা বাড়লো কোথায়? ১২ তলা আজকের বাস্তবতায় খুব উঁচু ভবন না এবং আগুনটাও ছিল মাঝারি মানের। অথচ সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৯ ইউনিট আর বিমান বাহিনীর দুই ইউনিটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করতে হয়েছে। কোথায় গেলো সেই অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার, আধুনিক যন্ত্রপাতি?
সহজ কাজ হলো ভবন নির্মাতাদের দায়ী করা। নিশ্চয়ই ভবন মালিক ও নির্মাতাদের দোষ থাকে। কিন্তু তাদের দোষ দেওয়ার আগে বিল্ডিং কোড, বা অগ্নিনিরাপত্তা বিধি কেউ না মেনে যদি স্থাপনা নির্মাণ করে তার দায় কি রাজউক, পূর্ত বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের কোনও দায় নেই? বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনের পর কত কথা আমরা শুনেছিলাম, কিন্তু এরপর শহরের কয়টা ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে? একটা সামান্য মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরটা যে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে সে ভাবনা কি কোথাও আছে?
মনমানসিকতা ও ব্যবস্থাপনার এমন হাল নিয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভব না। আগুন নেভাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগে, ফায়ার ফাইটারদের উন্নত প্রশিক্ষণ লাগে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি লাগে সদিচ্ছা। সেটা আমাদের সরকারি সংস্থাসমূহে অনুপস্থিত। মানুষ ভরসা পায় না, তাই আশপাশের মানুষ নিজেরাই ছুটে যায় মানুষ বাঁচাতে।
প্রতিটি আগুনের শিখা নির্বাপিত হলে দগ্ধাবশেষের পাশেই পড়ে থাকে একটি সত্য—এই আগুনই শেষ নয়। এ শহরের ভবিষ্যতে আরও অনেক আগুন, আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি লুকিয়ে আছে। এ শহরে আগুনই সত্য। মানুষের প্রাণ অমূল্য এবং দেশের মানুষের প্রতি তাদের করের টাকায় পরিচালিত সংস্থাগুলোর দায়বদ্ধতাও মূল্যবান– এ ভাবনাটা নেই কোথাও।
বারবার কেবল একটা বিষয়ই স্পষ্ট হয় – অভিজাত পাড়া থেকে ঘিঞ্জি এলাকা ও বস্তি, বড় কারখানা থেকে ছোট কারখানা, বড় মার্কেট থেকে ছোট ছোট দোকান, সব জায়গাই অনিরাপদ। কত কত প্রশাসন ও সংস্থা। কিন্তু তাদের মাথায় মানুষকে সেবা পরিষেবা দেওয়ার আগ্রহ কম। কোনও ব্যক্তি বিশেষের হয়তো আছে, কিন্তু তারা ব্যতিক্রম। দায়িত্ব যাদের, ন্যূনতম দায়িত্ব তারা পালন করেন না সেটাই সত্য। টাকা কম খরচ হয় না, কিন্তু কাজ হয় না। অমানবিকতার কারখানা যদি হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো, তাহলে প্রাণের দাম পাওয়া যাবে কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক