৩০ বছরের অপেক্ষায় দৃষ্টিনন্দন ভবনে এনবিআর, আরও একটি চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ গণপূর্ত অধিদপ্তর

প্রকাশিতঃ 9:44 am | February 27, 2023

গোলাম কিবরিয়া ইয়াছিন আরাফাত, কালের আলো:

গাড়িবারান্দা ও ফোয়ারা পেরিয়ে লবিতে ঢুকতেই যেন পাঁচ তারকা হোটেলের মতোই আমেজ। সুপরিসর লবিতে অতিথিদের বসার সুবন্দোবস্ত নজরে আসে। আছে ডানে-বাঁয়ে দুটি এসকালেটর ও ছয়টি লিফট। দোতলায় লেনদেনের জন্য রয়েছে ব্যাংকের বুথ। ক্যাফেটেরিয়ার ব্যবস্থা তো আছেই। প্রথম চারতলা পর্যন্ত আসা করদাতা-দর্শনার্থীদের জন্য নানা ধরনের সেবা বুথ। প্রথম দেখায় যে কেউ চমকে যেতে পারেন! কিন্তু চমক জাগানিয়া কোন উপাখ্যান নয় এটিই বাস্তবতা। চিত্রটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নতুন ভবনের।

প্রায় ৩০ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন এমনই ১২ তলার বিশাল ও দৃষ্টিনন্দন এক ভবন পেয়েছেন রাজস্ব কর্মকর্তারা। নতুন বছরের রোববার (০৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এমন নান্দনিক শোভামন্ডিত ভবনের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলত প্রতিষ্ঠার ৫০ ও চেষ্টা শুরুর ৩০ বছর পর রাজধানীর সেগুনবাগিচার কার্যালয় ছেড়ে এখন আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে পুরোমাত্রায় যাবতীয় কর্মযজ্ঞ চলছে এনবিআর’র।

কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাসহ নতুন রাজস্ব ভবনের মোট আয়তন ৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৭ বর্গফুট। প্রতিটি ফ্লোরের উচ্চতা ১৩ ফুট। বেজমেন্টের আয়তন ৬৬ হাজার বর্গফুট। নিচতলা থেকে চতুর্থতলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন ৪৪ হাজার বর্গফুট করে। পঞ্চম থেকে বাকি সব তলার আয়তন ৪৬ হাজার বর্গফুট।

নানা প্রতিবন্ধকতার পর নির্ধারিত সময়েই দৃষ্টিনন্দন এমন ভবন নির্মাণ করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে পথিকৃৎ গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের নেতৃত্বে আরও একটি বিশাল চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। কুড়িয়েছে প্রশংসাও।

তবে এই মহাকর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিলেও পুরো কৃতিত্ব প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক দিকনির্দেশনায় গণপূর্ত অধিদপ্তর টিম ওয়ার্কের মাধ্যমেই সুচারূভাবে কাজটি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।

নতুন ভবন পেয়ে উচ্ছ্বসিত এনবিআর’র কর্মকর্তারাও। তাঁরা বলছেন, দৃষ্টিনন্দন এই ভবনে এলে সরকারি অফিস সম্পর্কে করদাতা ও দর্শনার্থীদের গতানুগতিক ধারণা পাল্টে যাবে। কারণ, এখানে আধুনিক সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। অবকাঠামোগত সুবিধা থাকায় এখানে করদাতাদেরও দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭৬ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্ম। ৫০ বছরে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার গুণ। যে সংস্থাটি জাতীয় বাজেটের ৮৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেয়, এতদিন সেই প্রতিষ্ঠানেরই কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এনবিআরের এতোদিন কার্যক্রম চলেছে পাকিস্তান আমলের পুরনো ভবনে। ওই সময় এখানে ছিল সচিবালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এখানে কিছুদিন কাজ চলে সচিবালয়ের। এরপর সচিবালয় চলে যায় বর্তমান ঠিকানায়। আর সেগুনবাগিচার ওই ভবনে থেকে যায় এনবিআর।

জানা যায়, এনবিআর’র নিজস্ব ভবনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। ওই বছরই প্রথম রাজস্ব ভবন নির্মাণে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। শুরু হয় জমি সংক্রান্ত মামলার জটিলতা। এই জমিতে ভবন হবে কিনা তা নিয়ে তৈরি হয় সংশয়। এর মধ্যে পার হয়ে যায় ১০ বছর। শুরু হয় নতুন জটিলতা, তা কাটিয়ে উঠে ২০০২ সালে জমি বরাদ্দ পেলেও বুঝে পেতে বিলম্ব হয় ৬ বছর।

২০০৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদে ১৪১ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয় একনেকে। জমি নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি হলে ২০১৪ সালে সেই প্লট বুঝে পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জমি হাতে পেতে না পেতেই প্রথম প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তখনই কাজ করার সুযোগ পায় গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রথম প্রকল্প ভবনের নকশা পরির্তন করে পরিসর বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫১ কোটি টাকা। একাধিকবার মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয়।

এর মাঝেও আসে নতুন জটিলতা, ২০ তলা ভিত্তির ওপর ১২ তলা ভবন নির্মাণের কথা ছিল প্রথম প্রকল্পে। কিন্তু সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুমোদন ছাড়াই ৩০ তলা ভিত্তির ওপর ভবন নির্মাণ শুরু হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এর মধ্যে আবার বিপত্তি বাঁধে সরকারি দুই দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সেটি নেয়নি এনবিআর।

এ নিয়ে সরকারি দুই সংস্থার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। বিষয়টি গড়ায় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত। সংশোধনী প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০ তলা না করে ১২ তলা ভবন করতে হবে। কেননা বিমানবন্দর সন্নিকটে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১২ তলার ভৌত অবকাঠমোর কাজ সম্পন্ন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ২০২০ থেকে ২০২২ সব কাজ শেষ করে। বাংলাদেশের আধুনিক রাজস্ব ভবনের নির্মাণ শেষে চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি এনবিআরের নবনির্মিত রাজস্ব ভবনটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাছে হস্তান্তর করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নেতৃত্বে আসেন মোহাম্মদ শামীম আখতার। ওই সময়ই তিনি কচ্ছপ গতিতে চলতে থাকা এনবিআর’র ভৌত অবকাঠামোর কাজ দ্রুত শেষ করার কর্মপরিকল্পনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বিশাল এক চ্যালঞ্জে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে নিজ অধিদপ্তরের সক্ষমতার প্রমাণ মোটাদাগে উপস্থাপন করেছেন।

জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার দৈনিক সন্ধানী বার্তাকে বলেন, ‘রাজস্ব ভবন আমি এসে যেভাবে পেলাম; প্ল্যান করলাম বারবার স্থবিরতা থেকে বের হতে হবে, অন্তত ভৌত অবকাঠামোগত জায়গায় যেন দীর্ঘ না হয়। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, কাজটা শেষ করে ফেলতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরের সুযোগটাও আসবে।

আমি ও গণপূর্ত অধিদপ্তর সৌভাগ্যবান। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কান্ডারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আধুনিক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় গণপূর্ত অধিদপ্তরও সম্মুখ থেকে সফলতার সঙ্গেই কাজ করতে পেরেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনাতেই পুরো কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।’

কালের আলো/ইএ/এমকে