সংশোধনাগারে রূপ নিচ্ছে কারাগার, পণ্যের লভ্যাংশের অর্থ পাচ্ছেন কয়েদিরাও
প্রকাশিতঃ 12:34 pm | February 26, 2023

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:
জীবনের গতিপথের ভুলে আটকে কারান্তরীণ। পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন একেবারেই। অপরাধের জীবন থেকে আলোর পথে, সমাজের মূলধারায় ফিরতে ও আত্মনির্ভরশীলভাবে বাঁচতে সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া কয়েদিদের কার্যকর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। ‘বন্দীদের হাত হবে কর্মীর হাত’ ও ‘কারাগার হবে সংশোধনাগার’—এই দু’স্লোগান সামনে রেখে কয়েদিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। কয়েদিরাও নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পেয়ে সুকুমারবৃত্তি ও শৈল্পিক মনের পরিচয় দিচ্ছেন একদিন-প্রতিদিন।
কেউ নান্দনিকতার ছোঁয়ায় তৈরি করছেন জামদানি শাড়ি বা প্রিন্টের থান কাপড়। কেউ নিপুণ হাতে সেলাই করেন নকশী কাঁথা, বেডশীট ও পাটের ব্যাগ। অনেকেই দক্ষ বাঁশ ও প্লাস্টিকের মোড়া বানানোয় কেউবা আবার সোফায়। কারো হাতে বোনা উলেন কার্পেটের জুড়ি মেলা ভার। জামা ও পুথির কাজ করা এসব পণ্যে সহজেই আটকে যায় চোখ। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, টিভি মেরামত, এ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী, প্রেস ও বাধাই শিল্প, ব্যানার আর্ট ও ড্রইংয়েও কারও কারও হাত পাঁকানো।
নজরকাড়া ডিজাইন, গুণগত মান ও টেকসই হওয়ায় কারা পণ্য রীতিমতো একটি ব্র্যান্ড হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে। এসব পণ্যের লাভের অর্ধেক পাচ্ছেন কারাবন্দিরা। বাকি অর্ধেক জমা হচ্ছে সরকারি কোষাগারে। বছরজুড়েই কয়েদিদের তৈরি পণ্যের আলাদা কদর রয়েছে। কারাগারগুলোর বিক্রয়কেন্দ্রে হাত বাড়ালেই মেলে এসব পণ্যের।

গুণে মানে অনন্য এসব পণ্য প্রতি বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মেলার ‘কারা পণ্য বাংলাদেশ জেল’ নামক প্যাভিলিয়নে কারাবন্দিদের তৈরি পণ্যের চাহিদা ছিল শীর্ষে। কাঠের নৌকা, সিংহাসন চেয়ার, মডার্ণ চেয়ার, বেতের ঝুলন্ত দোলনা, প্লাস্টিক ও বাশের ফলঝুড়ি, প্লাস্টিকের ট্রে, কাঠের খেলনা কার্পেট, নকশী কাঁথা, পুতির কাজ, পুতির টিস্যু বক্স, পুতির কলমদানী, জামদানি শাড়ি, পাঞ্জাবির পিস, লেডিস সু, জেন্টস সু, বা কাঠের চামচ, বাশ ও বেতের কুলা, ফুড কভার- কী ছিল না সেখানে! এ সময় মেলায় কারা পণ্য বিক্রি হয়েছে ৩৮ লক্ষ ১২ হাজার ৫১০ টাকার। শুধু তাই নয়, মেলায় বাংলাদেশ জেল’র প্যাভিলিয়ন সি ক্যাটাগরিতে ‘দ্বিতীয় স্থান’ অর্জন করেছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক কালের আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার, কারাগার হবে সংশোধনাগার’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে কারাবন্দিদের দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন পণ্য। বন্দিদের কর্মময় ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ২০২১ সালে ৮ হাজার ১৩০ জন ও ২০২২ সালে ১১ হাজার ৪১৩ জন বন্দিকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রশিক্ষিতরা নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কারান্তরীণ জীবনে উপার্জন করছেন। অপরাধীর হাত কর্মীর হাত রূপ নিচ্ছে। কারাগার থেকে বেরিয়েও বন্দিরা প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের জন্য ও দেশের অগ্রযাত্রাতেও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারবেন।’
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক কারাগারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির লভ্যাংশের ৫০ শতাংশ কয়েদিদের দেওয়া হয়। এসব অর্থ তাঁরা নিজেদের জন্য খরচ করতে বা পরিবারকে দিতে পারেন। বাকি ৫০ শতাংশ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। কারাগারগুলোতে কারাপণ্য বিক্রয় বাবদ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪ লক্ষ ৪৫ হাজার ২০৭ টাকা ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯ লক্ষ ২৭ হাজার ৭২৪ টাকা বন্দিদের দেওয়া হয়েছে।

কারা পণ্যের চাহিদার বিষয়ে একাধিক ক্রেতা কালের আলোকে বলেন, ‘কয়েদিদের বানানো পণ্য সাধারণত ভালো হয়। তাঁরা দীর্ঘ সময় ও মনোযোগ দিয়ে যত্নসহকারে এসব পণ্য বানান। মানেও এসব পণ্য অসাধারণ। পাশাপাশি দামও সাধ্যের ভেতর।’
কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশিক্ষণ ও ক্রীড়া) মোসা: নাহিদা পারভীন কালের আলোকে এ বিষয়ে বলেন, ‘কারাবন্দিদের প্রশিক্ষণে সংশোধন ও পুনর্বাসনের পথ উন্মোচিত হচ্ছে। কারা পণ্যের উদ্যোগকে দেশজুড়ে বিস্তারের উদ্দেশ্যে ই-কমার্স সিস্টেম গড়ে তোলা হচ্ছে। যার মাধ্যমে বন্দিদের তৈরীকৃত দ্রব্য প্রদর্শন, দ্রব্যের বিস্তারিত তথ্য, দ্রব্যের অর্ডার গ্রহণ, দ্রব্যের ডেলিভারী প্রদান, দ্রব্যের অবস্থান (নিকটবর্তী কারাগার) প্রদর্শন করাসহ এসএমএস’র মাধ্যমে দ্রব্যের অর্ডার নিশ্চিত করা ও দ্রব্য সরবরাহ গ্রহীতার কাছে দ্রুততম সময়ে পৌছানো সম্ভব হবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে