বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস; ইচ্ছাপূরণ ‘অপরাজেয়’ মহামান্যের
প্রকাশিতঃ 10:41 pm | February 28, 2023

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:
বাংলাদেশের টানা দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানী। ‘মহামান্য’ নামেই সবাই সম্বোধন করেন তাকে। ব্যক্তিত্ব, আচরণ ও জনকল্যাণে হাওরবাসীর মনেও ‘মহামান্য’ নামেই তার সদর্প উপস্থিতি। আপামর জনসাধারণের মাথা নুইয়ে আসে তার প্রতি শ্রদ্ধায়। হাওরের প্রতিটি বাঁকই তার চেনা। এখানকার সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে তিনিই শিখিয়েছেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে। ফেলে আসা শৈশবে হাওরের বুকে টানা ১৩ ঘণ্টা সাঁতার কেটেছেন।
মুঠো মুঠো উন্নয়নে বদলে দিয়েছেন হাওরের চেহারা। ভোট রাজনীতিতেও ছিলেন ‘অপরাজেয়’। হারেননি কখনও। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরই তাঁর ইচ্ছা ছিল হাওরে একটি সেনানিবাসের। যে সেনানিবাস হাওর এলাকার সার্বিক নিরাপত্তায় রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একজন কৃষকের সন্তান থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে বসেছেন। দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরকে আরও একবার বিরল সম্মানেই ভূষিত করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আকাক্সিক্ষত সেনানিবাস। রাষ্ট্রপতির স্থানীয় কামালপুরের বাড়ির পাশে ঘোড়াউত্রা নদীর চরে নির্মিত হয়ে এটি। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেনানিবাসটির নামকরণও করেছেন ‘ভাটির শার্দুল’র নামেই। ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস’ নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আবহে এক অপরূপ আকর্ষণের পূর্ণতা দিয়ে মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) শুরু করলো পথচলা।
এদিন সকাল ১১ টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস’র উদ্বোধন করেন। সরকারপ্রধান বলেছেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছায় আমরা এই সেনানিবাসটি গঠন করেছি এবং তাঁর নামেই উৎসর্গ করেছি।’ সেনানিবাস উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেনানিবাস উদ্বোধনের পর একটি আম গাছের চারা রোপণ করেন।

সরকারপ্রধান সেনানিবাসের প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও ঘাটাইলের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী তাকে অভ্যর্থনা জানান। সেখানে তাকে গার্ড অব অনার দেন সেনা সদস্যরা। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পাঁচটি ইউনিটের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তিনি এ উপলক্ষে বেলুন ওড়ান। তারপর সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন সরকারপ্রধান।
চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাসের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ জেলায় মিঠামইনে নব প্রতিষ্ঠিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস হাওর এলাকার সার্বিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। তাছাড়া, দেশের উত্তর-পূর্বাংশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও জোরদার হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর চোখে মহামান্য আবদুল হামিদ
মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন অগ্নিসংগ্রামী হিসেবেও গৌরবগাঁথা ইতিহাস রয়েছে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের। ১৯৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্তও ভোট রাজনীতিতে তাঁর কোন হার নেই। জিতেছেন ’৭৯, ’৮৬, ’৯১, ’৯৬ ও ’২০০১ সালের নির্বাচনেও। সপ্তম সংসদে ডেপুটি স্পিকার, নবম সংসদে বিরোধী দলের উপ-নেতার দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতার সঙ্গে।
ছিলেন মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারও। নিরপেক্ষতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দীর্ঘদিন এই দায়িত্ব পালন করেছেন সফলতার সঙ্গেই। স্বভাবসুলভ রসিকতায় সব সময়ই প্রাণবন্ত করে রাখতেন সংসদকে। অর্জন করেছিলেন জনপ্রিয়তাও। হাওরের বাতাস আর এখানকার জল-মাটির সোঁদা গন্ধ বরাবরই তাকে টানে। দেশের সর্বোচ্চ আসনে থেকেও তিনি নিজেকে একটুকুও বদলাননি। তিনি সততার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ২০১৩ সালে তিনি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এ ভূষিত হন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্মৃতি সব সময় জ্বলজ্বল করে। তার বৈশিষ্ট্য, সাফল্য আর কৃতিত্বের কথা এলাকার জনশ্রুতিতে যেন ঘুরে সব সময়। দুর্গম হাওরে বেড়ে ওঠা দুইবারের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের যারপরেনাই প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রীও।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ, আমাদের রাষ্ট্রপতি। তিনি এ অঞ্চল থেকে বার বার নির্বাচিত হয়েছেন। সেই ৭০ এর নির্বাচন, ৭৩ এর নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্বাচনে তিনি জয় লাভ করেছেন এবং জনগণের সেবা করে গেছেন। এই দুর্গম অঞ্চলের মানুষের পাশে থাকা, তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়া, তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে আবদুল হামিদ নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তখন এ অঞ্চলে একটা সেনানিবাস করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। এটি এই অঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। তারই ইচ্ছায় এই সেনানিবাসটি আমরা গঠন করেছি। তার নামেই এ সেনানিবাস আমরা উৎসর্গ করেছি।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যখন যে দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে তার বিরাট অবদান রয়েছে। তিনি নিবেদিতপ্রাণ এবং সৎভাবে জীবনযাপন করে এদেশের মানুষের সেবা করে গেছেন। কাজেই তার নামে এই সেনানিবাস করতে পেরে আমরা সত্যিই খুব আনন্দিত।’
হাওরের বিমুগ্ধ বিস্ময়ের কথাও উঠে আসে সরকারপ্রধানের কন্ঠে। তিনি হাওর এলাকার মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বলেন, ‘মিঠামইন হাওর অঞ্চলটি বর্ষাকালে ছোট ছোট দ্বীপের মতো হয়ে যায়। এখন ঠিক তার বিপরীত। এখন আমরা দেখছি ফসলে ভরে গেছে, রাস্তাঘাট আছে। কিন্তু বর্ষাকালে ভিন্ন চিত্র। এ অঞ্চলের মানুষকে জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়।’

৫ টি ইউনিটের পতাকা উত্তোলন
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাসের ৪টি ইউনিট (পদাতিক, ইঞ্জিনিয়ার, এসএসডি ও সিএমএইচ) ও এসএসডি জাজিরা’র পতাকা উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও ঘাটাইলের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী, ও ৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হক নবনির্মিত ইউনিটসমূহের পতাকা উত্তোলন করেন।
বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ একটি ‘ব্র্যান্ড নেইম’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুমহান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলায় এবং দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম, অবকাঠামো নির্মাণেও সর্বোচ্চ সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একাগ্রতা, কর্মদক্ষতা এবং নানাবিধ জনসেবামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশের জনগণের মনে স্থান করে নিয়েছে। যেকোন দুর্যোগ, আর্ত-মানবতার সেবা ও জানমাল রক্ষায় সেনাবাহিনীর কর্তব্য ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সব সময় প্রশংসিত হয়ে আসছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ একটি ‘ব্র্যান্ড নেইম’ যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দায়িত্বশীলতা ও সহমর্মিতার সাথে দুর্গতদের পাশে থেকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং সমগ্র জাতির কাছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি আস্থার নাম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাসের প্রত্যেক সদস্যের পেশাগত দক্ষতা ও কর্মচাঞ্চল্যে এই সেনানিবাস অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অত্যাধুনিক সেনানিবাস হিসেবে পরিগণিত হবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে