সত্যনিষ্ঠতায় ভারতকে ‘অপ্রিয় সত্যে’র দিকনির্দেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর; কূটনৈতিক অঙ্গনে জোর চর্চা 

প্রকাশিতঃ 6:28 pm | March 03, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:

সত্যনিষ্ঠতায় ভারত সফরত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আবদুল মোমেন রীতিমতো ‘কঠোর বার্তা’ দিয়েছেন দেশটিকে। পরিশীলিত, সংক্ষিপ্ত, সহজবোধ্য ও বোধগম্যতার নিরিখে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে তাঁর বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবে জোর চর্চা শুরু হয়েছে কূটনৈতিক অঙ্গনে। এসব প্রস্তাবে ভারতের কথা উল্লেখ না থাকলেও মন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যকার অনেক ‘অপ্রিয় সত্যে’র প্রতিই দিকনির্দেশ করেছেন। 

দু’দেশের সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়ের যুগে থাকলেও একাধিকবার ভারতের বিভিন্ন কান্ডে বাংলাদেশে অস্বস্তিকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে নতুন মাত্রা দিতে মেধা আর অভিজ্ঞানে তাঁর সন্ধানী দৃষ্টিতে এসব বিষয়াদি খুঁটিয়ে তুলে এনেছেন ড.মোমেন। 

বুধবার (১ মার্চ) সন্ধ্যায় দিল্লির শীর্ষস্থানীয় স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনে (ভিআইএফ) প্রস্তাবে তিনি  আঞ্চলিক সহযোগিতাকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে বিবেকের কন্ঠস্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বিতর্ক ও বাগ্বিতণ্ডার উর্ধ্বে উঠে মননশীল সামগ্রিকতায় উদারতা ও সহিষ্ণুতায় প্রকারান্তরে বাস্তবতাকে উচ্চকিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আবদুল মোমেন প্রশংসিত হয়েছেন। নিজের প্রখর দক্ষ কূটনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির ও বিচক্ষণ নেতৃত্বকে সামনে এনেছেন। 

সূত্র জানায়, দিল্লির শীর্ষস্থানীয় স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনে (ভিআইএফ) পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাবসমূহের মধ্যে রয়েছে- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ পৃথিবীর অন্য যেকোনও অঞ্চলের চেয়ে কম। এই বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বাধা বা ব্যারিয়ারগুলো দূর করতে হবে। ‘একটা দেশ হঠাৎ করে খেয়াল-খুশি মতো আরেকটা দেশের ওপর ট্যারিফ বা নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বসিয়ে দিয়ে বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে ব্যাহত করলো, এভাবে তো চলতে পারে না। বরং এক দেশ যাতে অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে পারে, তার জন্য সব পারস্পরিক বিধিনিষেধ দূর করতে হবে’ বলেন ড.এ কে আবদুল মোমেন। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের ভূগোলই আসলে এই নিয়তি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে প্রাকৃতিক সম্পদকে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে–যার মধ্যে নদীর জলও আছে। এখানে একটি দেশ কিছুতেই অন্য একটি দেশকে তার ন্যায্য হিসসা থেকে বঞ্চিত করতে পারে না’, আরেকটি প্রস্তাবে বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

‘কোনও দেশ যাতে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে অন্য দেশের মানুষকে চটিয়ে না ফেলে, সেদিকেও যত্নবান হওয়ার কথা বলেছেন ড.এ কে আবদুল মোমেন। তার কথায়, ‘আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনও দেশ তাদের ঘরোয়া রাজনীতির ইস্যুগুলো দিয়ে অন্য দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের ভাবাবেগকে না আহত করে ফেলে!’ 

সূত্র জানায়, মাস দুয়েক আগেই ভারত বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর আরও পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য অত্যন্ত চড়া হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি বসিয়েছে। গত কয়েক বছরে একাধিকবার বাংলাদেশে পেঁয়াজ বা গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের রপ্তানি হুট করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ভারত সেখানে কোনও আগাম নোটিশও দেয়নি। 

প্রায় একযুগ হতে চললো তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে দু’দেশের মধ্যকার চুক্তির খসড়া তৈরি হয়ে আছে, কিন্তু ভারত এখনও তা সই করার জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। দেশের ভেতর রাজনৈতিক মতবিরোধের কথা বলে ভারত তিস্তা চুক্তিকে অনির্দিষ্টকালীনভাবে পিছিয়ে রেখেছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদীর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই ভারত যেহেতু উজানের দেশ, তাই ভাটির দেশ বাংলাদেশকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে, এ অভিযোগ বারবার উঠেছে।

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গরুর মাংস বহন করার জন্য মুসলিমদের পিটিয়ে মারা বা নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। আসামে এনআরসি অভিযানের নামে বাঙালি মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে কিংবা বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে ভারত সরকার মুসলিমদের প্রতি বঞ্চনার নীতি নিয়ে চলছে, এমন ধারণাও সৃষ্টি হয়েছে। 

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ঘটনা যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা মাথায় রেখে করা। কিন্তু এগুলো অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। বাংলাদেশের ঝানু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আবদুল মোমেন তাঁর সততা-নিষ্ঠা, মনন-মেধা ও প্রখর দক্ষতায় তার বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ের সরাসরি উল্লেখ না করলেও প্রস্তাবের আকারে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন তাতে তিনি যে এই বিষয়গুলোই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন সেটি মোটা দাগে স্পষ্ট। 

সূত্র জানায়, বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা ও ভারতের সাবেক ডেপুটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অরিবন্দ গুপ্তাও এসব প্রস্তাব তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এবং আশা প্রকাশ করেন, এগুলোর রূপায়ণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও সম্প্রীতি অবশ্যই বাড়বে। 

কালের আলো/এমএএএমকে