বোমার সঙ্গে নিত্য বসবাস
প্রকাশিতঃ 10:51 am | April 28, 2023
প্রভাষ আমিন:
আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদের ছুটি শেষ হয়ে গেছে। তবে ঈদের ছুটির রেশ রয়ে গেছে। টিভিতে বা ওটিটিতে ঈদের আয়োজন দেখে অনেকেই অলস সময় কাটাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীতে। রাজধানীর মগবাজার, ইস্কাটন, রামপুরা, মহাখালী, পূর্ব রাজাবাজার, ক্রিসেন্ট রোড, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বাড্ডা, হাজারীবাগ এলাকা থেকে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার খবর আসে। বিভিন্ন এলাকার মসজিদের মাইক থেকে গ্যাসের চুলা ও দেশলাই না জ্বালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
শুধু নির্দিষ্ট এলাকা নয়, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজধানীতে। অনেকে রাতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তোলপাড়। জরুরি সেবা ৯৯৯-এ অসংখ্য ফোন আসে। তৎপর হয় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাস্তায় নামে ফায়ার সার্ভিস। বিভিন্ন এলাকা থেকে আতঙ্কিত মানুষের ফোন আসে সাংবাদিকদের কাছে, গণমাধ্যম অফিসে। আমাদের ছেলে প্রসূন সেদিন কক্সবাজার ছিল। সেখান থেকে সে বারবার ফোন করে সতর্ক করছিল, আমরা যেন কোনোভাবেই চুলা না জ্বালাই। আমি তাকে আশ্বস্ত করি, আমাদের গ্যাসের লাইন সিলিন্ডারের, তিতাসের নয়। কিন্তু প্রশ্নটা আসলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার নয়, সামগ্রিক নিরাপত্তা বোধের। সোমবার রাতটা ঢাকার অনেক মানুষের নির্ঘুম কেটেছে। ঈদের আনন্দের রেশ এক ঝটকায় কেটে গেছে।
আল্লাহকে ধন্যবাদ, শেষ পর্যন্ত কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। পরে যেটা জানা গেলো, ঈদের ছুটিতে কলকারখানা বন্ধ থাকায় এবং বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাহিদা কম থাকায় তিতাসের লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যায়। তাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তিতাস গ্যাসের লাইনে লিকেজ সৃষ্টি হয় এবং গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তাতেই গ্যাসের গন্ধের সঙ্গে ছড়ায় আতঙ্ক। দ্রুত তিতাসের লাইনে গ্যাসের চাপ কমিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়। বড় কোনও দুর্ঘটনা না ঘটলেও অনেক বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে, অনেক ঝুঁকি সামনে এসেছে, এসেছে অনেক প্রশ্নও।
প্রথম কথা হলো, ঈদ তো বাংলাদেশে এবারই প্রথম আসেনি। ঈদের সময় যে গ্যাসের চাহিদা কম থাকবে, সেটা তো সবারই জানা। তিতাস কর্তৃপক্ষ জানতেন না। যাদের দায়িত্ব ছিল গ্যাসের চাপ মনিটর করা, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কমানো-বাড়ানো তারা কোথায় ছিলেন। যাদের অবহেলার কারণে রাজধানীবাসী আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটালো, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব প্রশ্ন আসবে, কিন্তু উত্তর আসবে না জানি। নামকাওয়াস্তে তদন্ত হয়তো হবে, কিন্তু তার ফলাফল কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না।
কোনও একটা ঘটনা ঘটলেই আমরা বলি, এটা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, আমরা সমস্যাটা জেনেছি, এখন সমাধান করবো। কিন্তু আসল সমস্যা হলো, চোখ খুললেও আমরা পুরোটা দেখি না। খোলা চোখ আবার বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাই। তিতাসের সরবরাহ লাইন যে ঝুঁকিপূর্ণ, এটা তো আমরা সোমবারে জানিনি, বারবার জেনেছি, বারবার আমাদের চোখ খুলেছে, বারবার আমরা বন্ধ করেছি। বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই। গত মাসের ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা এবং সিদ্দিকবাজারে প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ ঘটেছিল তো তিতাসের গাফিলতির কারণেই। এর আগে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণ বা মগবাজারের বিস্ফোরণও খুব পুরোনো নয়। বারবার দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে, কিন্তু কোনোটাতেই তো আমাদের টনক নড়েনি।
গোটা ঢাকায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে তিতাসের সরবরাহ লাইন। তার অনেকগুলো ৪০ বছরের পুরোনো। অনেক লাইন ঝুঁকিপূর্ণ। কোথায় কোন লাইনে কত ছিদ্র আছে, তা আমরা ঠিকমতো জানিও না, আমার ধারণা তিতাস কর্তৃপক্ষও জানেন না। কোথাও ঘটনা ঘটলে তারা তাৎক্ষণিক জোড়াতালির সমাধান দেন বটে, তাতে ঝুঁকি কমে না। সত্যি কথা বলতে, গোটা ঢাকা তিতাসসৃষ্ট একটা বোমার ওপর বাস করছি। ভাগ্য ভালো, এই বোমা নিয়মিত বিস্ফোরিত হয় না। হঠাৎ হঠাৎ মগবাজার, সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা সিদ্দিকবাজারের মতো ঘটনা ঘটলে আমরা একটু নড়েচড়ে বসি। তারপর আবার ঘুমিয়ে যাই।
তিতাসের সরবরাহ লাইন নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রথম কথা হলো মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া। একটি লাইনের মেয়াদ হতে পারে সর্বোচ্চ ৩০ বছর। কিন্তু ১০ বছর আগেই মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া ৪০ বছরের পুরনো লাইন তো এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। দ্বিতীয়ত অনেক এলাকায় মানুষ তিতাসের লাইন ছিদ্র করে অবৈধ লাইন নেন। তাতে ওই এলাকায় ঝুঁকি তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা তৈরি করে তিতাস কর্তৃপক্ষ নিজেরাই। নানা কারণে গ্রাহকদের লাইন সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে তারা। লাইন সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলেও গ্যাস সরবরাহ কিন্তু বিচ্ছিন্ন লাইনের রাইজার পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে গ্যাস লিক করে কোথায় জমা হয়ে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সিদ্দিকবাজারে এমন একটি বিচ্ছিন্ন করা লাইন থেকে লিক হওয়া গ্যাস জমেই বিস্ফোরণ হয়েছিল। এর আগে মগবাজারের বিস্ফোরণও ঘটেছিল সাময়িক বিচ্ছিন্ন করা লাইন থেকেই। পত্রিকায় দেখলাম, এমন সাময়িক বিচ্ছিন্ন লাইনের সংখ্যা ৩৫ হাজার। বছরের পর বছর সাময়িক বিচ্ছিন্ন হওয়া এসব লাইনে সিদ্দিকবাজারের মতো কত বোমা তৈরি করেছে আমরা টেরও পাচ্ছি না। কার্যত আমরা বোমার ওপর বসে আছি। বিস্ফোরণ হলেই কেবল টের পাবো।
সোমবারের ঘটনা দ্রুত জানাজানি হওয়ার কারণ হলো, তিতাস তাদের লাইনের ত্রুটি চিহ্নিত করতে সরবরাহ করা গ্যাসে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করে। ফলে কোথাও লিক হলেই সেটা টের পাওয়া যায় সহজেই। তবে টের পেলেই তো হবে না, ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে হবে এবং সবগুলোই। তিতাস কর্তৃপক্ষের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাইপলাইনের বাস্তব অবস্থা জানতে একটি জরিপ করা হয়। জরিপে তিতাসের ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে ১ হাজার ৬৮২ কিলোমিটার লাইন বেছে নেওয়া হয়। জরিপে ৯ হাজার ৯২৬টি স্থানে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই ১ হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে ৪৫৯টি ছিদ্র পাওয়া যায় এবং ছিদ্রগুলো বন্ধও করা হয়। কিন্তু এখনও ১১ হাজার ৬৩৮ কিলোমিটার পাইপলাইনে জরিপও করা হয়নি। তাতে আমরা জানতেই পারছি না আরও কত ছিদ্র আছে, আমরা আসলে কতটা ঝুঁকিতে আছি।
পয়সার অভাবে নাকি তিতাস কর্তৃপক্ষ মেয়াদোত্তীর্ণ লাইন বদলাতে পারছে না। তিতাস কিন্তু চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান নয়। তারা অর্থের বিনিময়ে নগরবাসীকে গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু তিতাসের দায়িত্ব শুধু গ্যাস সরবরাহ করা নয়, নিরাপদে গ্যাস সরবরাহ করাটা তারচেয়েও বেশি জরুরি। আমাদের কাছ থেকে যে অর্থ নেওয়া হয়, তা দিয়েই তাদের গ্যাস সরবরাহ, সরবরাহ লাইন নিরাপদ রাখতে হবে। টাকা নেই, এই অজুহাতে গোটা রাজধানীকে দিনের পর দিন ঝুঁকির মধ্যে রাখতে পারে না। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলতে পারি। আর নিজেদের নিরাপদ রাখতে তিতাসের ঝুঁকিপূর্ণ লাইন বদলাতে পারবো না, এটা কোনও কাজের কথা নয়।
প্রথম কথা হলো, যেভাবেই হোক মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ লাইন বদলে ফেলতে হবে। বাকি লাইনগুলোর ওপর নিয়মিত নজরদারি জারি রাখতে হবে। খুঁজে খুঁজে সব ছিদ্র বন্ধ করতে হবে। অবৈধ লাইন বন্ধ করতে হবে। আর সাময়িক বিচ্ছিন্ন করা সব লাইন সময় মতো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস করার কোনও সুযোগ নেই। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন, সেখানে টাকা কোনও সমস্যা না হয় যেন।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ