ভয়কে জয় করতে হবে
প্রকাশিতঃ 11:43 am | May 20, 2023
প্রভাষ আমিন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। আর তাদের এই নিয়ন্ত্রণ চেষ্টা নতুন কিছু নয়। বহুকাল ধরেই তারা এই মাতব্বরি করে আসছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে বিশ্ব রাজনীতিতে একটা ভারসাম্য ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আগে থেকেই বিশ্বের অধিকাংশ বড় রাজনৈতিক হত্যা, ক্যু, সরকার পরিবর্তনের পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র হাত থাকতো। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে নিজেদের একক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হওয়ার পর আর আগের মতো লুকোছাপা দরকার হতো না। যেখানে ইচ্ছা সেখানে নাক গলানোর অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যায় তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে একে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান ধ্বংস করে দেয়। গোটা বিশ্বটাই যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খেলার পুতুল, যেমন ইচ্ছা তেমন খেলা যায়। তাদের এই আধিপত্যে কিছুটা বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। তাতেই তাকে কোণঠাসা করতে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার অজুহাতে যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনে হামলাটা প্রথম রাশিয়াই করেছে, কিন্তু ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করলে আসলে রাশিয়ার উঠান পর্যন্ত ন্যাটোর বিস্তৃতি ঘটবে। তাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে। আসলে চালাতে বাধ্য হয়েছে। দৃশ্যত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হলেও আসলে ইউক্রেনের পেছনে আছে পশ্চিমা বিশ্ব। নইলে রাশিয়া আর ইউক্রেনের শক্তির যে হিসাব তাতে যুদ্ধটা একতরফা হওয়ার কথা ছিল।
বাংলাদেশের জন্মটাই অপ্রতিরোধ্য আমেরিকার জন্য এক বড় পরাজয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও সরকার ছিল বিপক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের বিজয় ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে, এমনকি সপ্তম নৌবহরও পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারপরও তাদের চেষ্টা থামেনি। বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র একাত্তরেই থামেনি। ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনে মার্কিন হাত ছিল। এমনকি ৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনেও মার্কিন ষড়যন্ত্রের কথা জানা যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। তবে মার্কিন খবরদারি থামেনি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বরাবরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় প্রভাবক। অবশ্য শুধু মার্কিন রাষ্ট্রদূত নন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরাও যেকোনও সংকটে কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হন। আমাদের নতজানু মানসিকতাই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের প্রভাবশালী হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তবে বরাবর বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে অভ্যস্ত কূটনীতিবিদরা গত ১৪ বছরে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। বাস্তবতা হলো বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের অভ্যাস খাপ খাওয়াতে পারেননি। বাংলাদেশ যে এখন আর নতজানু নয়, মর্যাদাবান রাষ্ট্র, সেটি যেন তারা মানতে পারছেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রশ্নে কাউকে পাত্তা দিতে রাজি নন। গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারও নাম উল্লেখ না করে বলেছিলেন, ‘বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যাদের দিয়ে আমরা জঙ্গিবাদ নির্মূল করি, তাদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বলেছি যে যারা নিষেধাজ্ঞা দেবে, তাদের কাছ থেকে আমি কিছু কিনবো না।’ এর দুদিন পর জাপান-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশকে যারা স্যাংকশন দিচ্ছে তাদের সঙ্গে কেনাকাটা বন্ধ করবেন বলে বক্তব্য এসেছে। সে ক্ষেত্রে কি ভীত হওয়ার কোনও কারণ আছে?’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এত দুশ্চিন্তার কী আছে। কথা নাই বার্তা নাই, অমনি স্যাংকশনের ভয় দেখাবে। আর আমরা ভয়ে চুপ হয়ে বসে থাকবো। কেন? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। যারা আমাদের সপ্তম নৌবহরের ভয় দেখিয়েছিল, সেটাও পার করে বিজয় অর্জন করেছি। এ কথা ভুললে চলবে না। এই আত্মবিশ্বাসটা নিয়ে চলতে হবে। এক বেলা খেয়ে থাকবো, তাতে অসুবিধা নাই।’
এবার স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছেন। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনও তা স্বীকার করেছে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সফরে উপযুক্ত প্রটোকল না পাওয়ায় প্রতিশোধ হিসেবেই প্রধানমন্ত্রীর এমন কথা বলছেন। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, শেখ হাসিনা বরাবরই দেশের মর্যাদার প্রশ্নে অনড়। এর আগে এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পাঁচ বছর চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি। গত বছরের নভেম্বরে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় এক খুনি (বঙ্গবন্ধুর খুনি) রয়ে গেছে। তাকে বারবার আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেহেতু তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে, আমেরিকা সেই খুনিকে লালন-পালন করছে। অবশ্য আমেরিকার কারবারই এরকম। গত ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদেও শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে, যার গণতান্ত্রিক কোনও অস্তিত্ব থাকবে না।’ আমেরিকা চাইলে যেকোনও দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে, এমন মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে ক্ষমতা ওল্টাতে-পাল্টাতে পারে এটা জেনেও কিন্তু শেখ হাসিনা চুপ থাকেননি। তাদের অন্যায় খবরদারির ব্যাপারে সোচ্চার থেকেছেন। আমেরিকার কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়াতেই ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেননি বলে শেখ হাসিনা একাধিকবার অভিযোগ করেছেন।
অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ কেনাকাটা বন্ধ করে দিলে জবাবে যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দেয়; তাহলে তো বাংলাদেশ বিপাকে পড়বে। আশঙ্কা অমূলক নয়।
তবে মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু দয়া করে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে না। তারা সবচেয়ে সস্তায় পায় বলেই বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর সময়ও অনেকে বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা বন্ধ করে দিতে পারে। তাতে বাংলাদেশ বিপাকে পড়বে, কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাশেই ছিল। বরং সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে জমকালো আয়োজনে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বব্যাংকের প্রধানের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি। আসলে ব্যক্তি হোক, দেশ হোক, বিশ্বব্যাংক হোক, যুক্তরাষ্ট্র হোক; পাত্তা পেতে হলে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাড়াতে হবে। ন্যায্য কথা বলতে হবে সাহসের সঙ্গে। নতজানু হয়ে থাকলে সবাই খবরদারি করবে। ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আগের সেই দিন আর নেই। এই বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ