সেনাবাহিনীর দখলে কেএনএফ’র ঘাঁটি, মরণকামড় দিলে প্রতিহতের ঘোষণা সেনাপ্রধানের
প্রকাশিতঃ 10:10 pm | June 04, 2023

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) মূল ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দখলে নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। রোববার (৪ মে) দুপুরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান রিজিয়ন পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে এমন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড. এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।
নিশ্চিত করেছেন দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কথা। অচিরেই পাহাড়ের এসব সন্ত্রাসী নির্মূলের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা যেমন জানিয়েছেন তেমনি শান্তিপূর্ণভাবেই সবকিছুর সমাধানের ভাষ্যও উচ্চারিত হয়েছে তাঁর জবানীতে। মেধা-মনন, পেশাদারিত্ব আর অকাট্য যুক্তির নিরিখে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বলেছেন, ‘কেউ মরণকামড় দিলে আমরাও প্রতিহত করবো, এটিই স্বাভাবিক।’
সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যদি আত্মসমর্পণ কিংবা আলোচনায় বসতে চায়, এই বিষয়ে পদক্ষেপ কী হবে- গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নে সোজা সাপ্টা জবাব দিয়েছেন- ‘অবশ্যই, কেউ যদি আসতে চায় তাদের স্বাগত।’ শান্তিতেই সমাধানে বিশ্বাসী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই চার তারকা জেনারেল বলেছেন, ‘শান্তিতে যা সমাধান হবে সেটা সহিংসতায় কেন যাবো?’
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পার্বত্য জেলা বান্দরবানকে সাম্প্রতিক সময়ে রীতিমতো অস্থির করে তুলেছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে নষ্ট করেছে শান্তি-শৃঙ্খলা। এই সন্ত্রাসীদের অতর্কিত আইইডি বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক সেনা সদস্য। জনজীবন থমকে দেওয়া কেএনএফ’র মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিহত করতে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কঠিন এই সময়টিতে নিজ বাহিনীর সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা করার পাশাপাশি কমান্ডাররা কীভাবে অভিযান পরিচালনা করছে, কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে, সেনা সদর দপ্তর অভিযানকে আরও ফলপ্রসু করতে কী কী সহায়তা করতে পারে এসব বিষয়াদি সামনে রেখেই রোববার (৪ মে) দুপুরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান রিজিয়ন পরিদর্শন করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ড. এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

যে লক্ষ্য সামনে রেখে সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে সেটি অর্জিত হওয়া নিয়েও আশাবাদী তিনি। গণমাধ্যমকে এ প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, ‘যে অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমাদের অফিসার ও সৈনিকরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে আমি আশাবাদী। যে অভিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা এই অপারেশন করছি সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো।’
বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনন্য মানবিকতার উদাহরণ তুলে ধরে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খুবই মানবিক। সারাবিশ্বে মানবিকতার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিখ্যাত। জাতিসংঘে অনেকদিন ধরে আমরা এক নম্বর শান্তিরক্ষাকারী দেশ। এটি অর্জনের পেছনে যতগুলো গুণাবলি আছে তার মধ্যে অন্যতম মানুষের প্রতি দরদ ও সহনশীলতা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি। এটি আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি। কেউ যদি দেশের ক্ষতি করে, দেশের জনগণের ক্ষতি করে, সেটি রোধ করতে গিয়ে যদি আমাদের শক্ত অবস্থানে যেতে হয়, অবশ্যই যাবো। কিন্তু তা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই সবকিছুর সমাধান চাই। কেউ মরণকামড় দিলে আমরাও প্রতিহত করবো, এটিই স্বাভাবিক।’
জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কারণে স্পেশাল অপারেশন কন্ডাক্ট করছি। সন্ত্রাসীদের তৎপড়তা এত বেশি বেড়েছে যার ফলশ্রুতিতে আমাদের কিছু সেনাসদস্যকে হারিয়েছি, যা আমাদের চলমান অপারেশনকে থামাতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এটি খুবই দুরূহ অঞ্চল। একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে কাছে, কিন্তু সেটিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে কয়েক ঘণ্টা। হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমরা সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাচ্ছি, তা দখল করেছি। তাদের মূল ঘাঁটি ও মূল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দখল করেছি। তারা এ এলাকায় এখন আর নেই। তাদের কিছু কিছু জনগণের সঙ্গে মিশে আছে।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চলমান অভিযান প্রায় শেষের পথে এমনটি জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আপাতত আমরা সিচুয়েশন স্টাবিলাইজ করেছি। আরও কিছু এলাকা ক্লিয়ার করবো। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজিবি তারা ধীরে ধীরে তাদের দায়িত্বগুলো করতে থাকবে। সেনাবাহিনীর যে অভিযান তা প্রায় শেষ করে এনেছি। আশা করছি আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে শেষ করতে পারবো।’

পাহাড়ি জঙ্গলে শক্তিশালী বোমা আইইডি পুঁতে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আইইডি একটি নতুন মাত্রা। আইইডি মাটির ভেতর কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে এগুলো ডিটেক্ট (শনাক্ত) করা খুবই খুবই ডিফিকাল্ট (কঠিন)। খুব জঙ্গলাকীর্ণ রাতের অন্ধকারে বের করা আরও কঠিন। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে চেষ্টা করছি আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে। আইইডি শনাক্তে প্রয়োজনে ডগ স্কোয়াডসহ অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করা হবে। আমি আশা রাখছি, ভবিষ্যতে আইইডিতে হতাহতের সংখ্যা কমে আসবে ইনশাআল্লাহ।’
সেনাপ্রধানের প্রেস ব্রিফিং’র সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান এবং রামুর জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/এমএএএমকে