তাহলে আলোচনার দরজা বন্ধ?
প্রকাশিতঃ 11:48 am | July 15, 2023
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
বিএনপি এবং তার সাথে সমান্তরাল চলা আরও কিছু ছোট ও মাঝারি রাজনৈতিক দলের বহুল প্রচারিত ১২ জুলাইয়ের ঢাকা সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হলো। এ কথা সত্য যে, একটা সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আশংকা ছিল। কারণ ঠিক একই সময় এক কিলোমটারের ব্যবধানে পাল্টা সমাবেশের ডাক দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে রাজপথ দখল করে সমাবেশ করে নাগরিকদের জন্য ভয়াবহ দুর্ভোগে ফেললেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে দুই দলের সমাবেশ।
দুই দলই এক দফার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার ঘোষণায় বলেন, অবৈধ কর্তৃত্ববাদী ভোটাধিকার হরণকারী সরকারের পদত্যাগ এক দফা দাবি। আবার যে সরকারকে তিনি অবৈধ বলছেন তার কাছেই দাবি করছেন যে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করতে হবে।
অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপির এক দফার আন্দোলন ঘোষণার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাঁরাও এক দফা ঘোষণা করছেন এবং সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের প্রদর্শনী এমন এক সময়ে হলো যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করছেন।
সহজেই অনুমেয় যে, আলোচনার পরিসর রাখতে রাজি নয় দুই দল এবং উভয়পক্ষই সংঘাতের পথে হাঁটতে আগ্রহী। প্রশ্ন হলো তাহলে এই যে বিদেশিদের কাছে এত এত নালিশ আর অভিযোগ, তাদের এত দৌড়ঝাঁপ সেগুলো তাহলে কী বিফলে যাবে?
মানুষ যখন চলমান রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চাচ্ছে, তখন বড় দুই দলের যুদ্ধংদেহি মনোভাব সবাইকে আতংকিত করছে। অতীতের জ্বালাও, পোড়াও, বিশেষ করে ২০১৪/১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসী সহিংস আনদোলনের ভয়াবহতার পর মানুষ এখন আন্দোলনকে ভয় পায়।
এই রাজনীতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল তার কোনও মতাদর্শ ও কার্যক্রম নেই। সে শুধু ক্ষমতা খোঁজে। এই আলগা মতাদর্শের পাশাপাশি থাকে কিছু জনমোহিনী স্লোগান। যেগুলি শুনতে বেশ, কিন্তু তলিয়ে ভাবলে তাদের নির্দিষ্ট মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই শ্লোগানই দিচ্ছে সব পক্ষ।
আমাদের রাজনীতিকরা তাদের কর্মসূচিকে ‘গণ-আন্দোলন’ বলেন। তবে সেটা ‘জন’ আন্দোলন কিনা সে নিয়ে বিতর্ক আছে। এসব সমাবেশে প্রচুর মানুষ যোগদান করলেও আমরা এমন আন্দোলন দেখিনা যেখানে উত্তুঙ্গ অবস্থাতেও সর্বোচ্চ নেতার আদেশে আন্দোলনকারীরা প্রয়োজনে নিজেদের আবেগ সংহত রেখে চলবে। আমাদের এখানে আন্দোলনের সফলতা চিন্তা করা হয় ভাংচুর, আগুন, রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করা এবং লাশ ফেলার পারদর্শীতায়।
এই রাজনীতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল তার কোনও মতাদর্শ ও কার্যক্রম নেই। সে শুধু ক্ষমতা খোঁজে। এই আলগা মতাদর্শের পাশাপাশি থাকে কিছু জনমোহিনী স্লোগান। যেগুলি শুনতে বেশ, কিন্তু তলিয়ে ভাবলে তাদের নির্দিষ্ট মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই শ্লোগানই দিচ্ছে সব পক্ষ।
কথোপকথন সংলাপ, কথাবার্তা রাজনীতিতে পরিচিত শব্দ, রাজনৈতিক কাজকর্মের অঙ্গ। কিন্তু কথোপকথন বা সংলাপকে ঘিরে রাজনীতি এবং কথোপকথনকে সম্বল করে এগিয়ে যাওয়ায় আমাদের রাজনীতি অনভ্যস্ত। বলা হচ্ছে, বিএনপি ও তার সমমনাদের এবারের এক দফার লক্ষ্য ঢাকা। রাজধানীতে বড় সমাবেশ করে সরকার পতনের রাজনীতিকে গতিময় করা। তারা মনে করছে ঢাকাকে অচল করে ফেলতে পারলেই সরকারের পতন ঘটবে।
কিন্তু বিষয়টি কী এতই সহজ সরল? ঢাকা আচল করে দেওয়া এবং দিতে পারলেই সরকারের পতন? প্রথম কথা হলো, ঢাকাতে বড় সমাবেশ বিএনপি ঘটাতে পারলে আওয়ামী লীগও বসে থাকবে না, তারাও চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়ত: এর আগেও আমরা দেখেছি শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশই আগুন সন্ত্রাসে অচল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি।
ইতোমধ্যেই এক দফার ঘোষণা দিয়ে বিএনপি এখন বলছে এখন সিরিজ কর্মসূচি আসবে। স্বভাবতই, এই নির্বাচনী বিএনপির সব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে আওয়ামী লীগ। বিএনপির আন্দোলন যদি সহিংস হয় তালে আঘাত এবং পাল্টা আঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং জনজীবনে বড় প্রভাব পড়বে। ক্ষমতার রাজনীতিতে আন্দোলন করা ও আন্দোলন মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের আছে।
যে কোনো আন্দোলন সফল করতে জনসংশ্লিষ্টতা লাগে। গত এক বছর ধরে বিএনপির সমাবেশগুলোতে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, সমাবেশ বড় হচ্ছে এবং সেটা দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সেটা মনে রেখে তার রাজনৈতিক পথ ঠিক করবে।
আগামী নির্বাচনের আগে দেশে বিদেশিদের তৎপরতা বাড়াতে পেরেছে বিএনপি। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় তাদের দৌড়ঝাঁপও বেশি। এখনও ইরোপীয় ইউনিয়নের একটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় অবস্থান করছে। তবে নির্বাচন প্রশ্নে শেখ হাসিনার সরকার এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের মনোভাব একদম খোলাসা। সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কারভাবে এ বার্তা জানিয়েছেন দেশ-বিদেশ সব জায়গায়। বিদেশিরাও অরাজনৈতিক কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচনের চাপ দেয়নি এখনও এবং দিবে বলেও মনে হচ্ছে না।
তাহলে বিএনপি কী করবে? এক দফারই বা কী হবে? টানা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। ১৯৭৫-এর পর একুশ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। অত্যন্ত বৈরি পরিবেশে আন্দোলন করে করে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বিএনপির সমস্যা পরিষ্কার। ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেওয়া এবং ক্ষমতামুখী কোনো দলের জন্য এমন দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা কঠিন। বিএনপি এর আগেও সরকার পতনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান গত বছর বলেছিলেন– ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। আর কারও কথায় দেশ চলবে না’। কিন্তু কিছু হয়নি। এখন দেখার পালা এবার কী করতে পারে দলটি। তবে একটা কথা বোধ হয় মনে রাখা দরকার যে, বারবারই অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন লিমিটেড।