পরিকল্পিত নগরায়ণ ও ভবন নির্মাণ কমাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ

প্রকাশিতঃ 11:23 am | July 22, 2023

মো. শাহ জালাল মিশুক :

চারদিকে গাছগাছালিতে সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি অপরূপ শহর, আছে অনেক জলাভূমি, সেই জলাশয়ে আছে ব্যাঙসহ অন্যান্য প্রাণী। পাঁচতলার চেয়ে উঁচু কোনও ভবন ছিল না। থাকলেও কম, হাতেগোনা। সত্তর কিংবা আশির দশকের সেই নয়নাভিরাম রাজধানী ঢাকার কথা এখন নগরবাসীর কাছে অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। বর্তমান ঢাকায় ব্যাঙের দেখা মিলবে না। অথচ মশা হচ্ছে ব্যাঙের একমাত্র প্রিয় খাবার। অপরিকল্পিত নগরায়ণে জলাশয় ভরাট করার সময় থেকেই ব্যাঙ বিলুপ্তির পথে। মশার প্রসঙ্গ হঠাৎ কেন এসেছে সেটা মনে হয় কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর তেমন দরকার নেই। কারণ, দেশের প্রায় ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।

শুধু ঢাকাতেই গত ১৬ দিনে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৪২ জন। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার। এই দুটি তথ্যই বলে দিচ্ছে ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় একদিনে আগের সব রেকর্ড ভেঙে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মারা গেলেন ১২৭ জন। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫৩৩ জন।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। তখন এটিকে ‘ঢাকা ফিভার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাবে ৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জন মারা যান। বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ হাজার ৩২১ ও ২৮১।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বছরের এক জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে যেসব উৎসে,, সেগুলো হলো পরিত্যক্ত টায়ার (২২.৯০ %), বেজমেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি (১১.২৯ %), প্লাস্টিকের ড্রাম (৭.৭৪ %) ইত্যাদি। এ ছাড়া আর যেসব স্থানে এডিস মশা পাওয়া যায় সেগুলো হলো, পানির ট্যাংক (৪.৮৪ %), প্লাস্টিকের বালতি (৪.৮৪ %), ফুলের টব ও ট্রে (৩.৮৭ %), মাটির পাত্র (৩.৮৭ %), রঙের কৌটা (৩.৫৫ %), টিনের ক্যান (৩.২৩ %), প্লাস্টিকের মগ/বদনা (২.৯০ %) ইত্যাদি।

শুধু বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজনন হচ্ছে, এ অবস্থা আর নেই। কারণ নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি- এই চার মাস বলা যায় দেশে একদমই বৃষ্টি হয় না। অথচ এ বছরের শুরুর দিকেও এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে।

রাজধানী ঢাকার মশা নিয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের রিপোর্টের ফলাফল অনুযায়ী, ডেঙ্গু জ্বর এখন সারা বছরের বিষয় হয়ে গেছে। এর কারণও আছে। ঢাকা শহরে নগরায়ণের পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে। বেজমেন্টে গাড়ি রাখার জায়গা করা হয়েছে। সেখানে গাড়ি ধোয়াও হয়। বেজমেন্টে তাই পানি জমে থাকে। এমন জায়গায় এডিস মশাও পাওয়া গেছে। একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় ভবনগুলো তৈরি হয় দীর্ঘ সময় ধরে। কোভিড মহামারির পরে নির্মাণকাজ আরও ধীরে চলছে। বড় ভবন তৈরিতে অনেকাংশেই ৫-১০ বছর লেগে যেতে পারে। তাই এসব জায়গায় পানি জমে থাকে। আবার ঢাকা শহরে পানির সংকটের কারণে নগরবাসী ড্রামে, বালতিতে পানি জমিয়ে রাখে। এসব জমা পানিও এডিস মশার প্রজননস্থল। এগুলোর সঙ্গে বৃষ্টির কোনও সম্পর্ক নেই। তাই বৃষ্টির মৌসুম ছাড়াও আমাদের দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে।

একটি নগরীতে ক্রমাগত অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও বিভিন্ন পরিবেশগত কারণ ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ক্রমাগত জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি, মানুষের অবাধ যাতায়াত, ব্যবহারযোগ্য ও পানযোগ্য পানির স্বল্পতা ও বিভিন্নভাবে পানি সংরক্ষণ এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক কিংবা প্যাকেটজাত খাবার ও বোতলজাত প্লাস্টিকে পানীয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এসব বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার কারণে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা না থাকলেও এটি অনুমান করা যায় যে করোনাভাইরাসের মতো এটিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে সক্ষম। সাধারণত এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায় আর এই মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ, এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশবিস্তার করে। জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনও কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল, তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।

তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পরিকল্পিত নগরায়ণের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক গাছ থাকতো, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা থাকতো এবং মাটি থাকতো, তাহলে আবাসিক বা ইজিপ্টি প্রজাতির আক্রমণ থেকে নগরবাসী যেমন রক্ষা পেতো, পাশাপাশি সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্টদেরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সহজ হতো। এক কথায় বলা যায়, সুস্থ জীবনধারণের জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণের বিকল্প নেই।

এ ভবনগুলোতে এডিস মশার লার্ভা নির্বিঘ্নে উড়ন্ত মশায় পরিণত হয়। এ কারণে এ ভবনগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মানুষের অসচেতনতাও দায়ী। দুই সিটি করপোরেশনের বহুতল ভবন এবং নির্মাণাধীন বাড়িতে সবচেয়ে বেশি এডিসের লার্ভা মিলেছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ। এই অবস্থায় সবার সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

মোদ্দাকথা হলো, ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে নির্মাণাধীন ভবন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা আছে। কীভাবে ব্যবস্থাপনা করলে ডেঙ্গু মশা উৎপন্ন হবে না সেটি সেখানে অতিদ্রুত যুক্ত করা প্রয়োজন এবং ডেঙ্গু রোগী এবং ডেঙ্গু মশার প্রজনন তথ্য সংগ্রহ ও স্থানগুলো চিহ্নিত করে রিয়াল টাইম ম্যাপিং করাও দরকার। কারণ এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং ম্যাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাধারণ নাগরিকদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নিজের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিজেরও। তাই পরিকল্পিত নগরায়ণ ও ভবন নির্মাণ এবং নগরবাসীর জনসচেতনতার মাধ্যমে সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক সময়ে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা সম্ভব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চুয়েট।