৮ মাস ঢাকায় নাথান বম, বাসা ঠিক করে দেন শারক্বীয়ার আমির

প্রকাশিতঃ 4:02 pm | July 24, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথান লনচেও বম ২০২২ সালের আট মাস ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। রাজধানীর বাসাবো এলাকায় তাকে বাসা ঠিক করে দেন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির মো. আনিসুর রহমান মাহমুদ।

রোববার (২৩ জুলাই) রাতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থেকে আনিসুরকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব)। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন দুই দেহরক্ষী কাজী সরাজ উদ্দিন রিয়াজ ও মাহফুজুর রহমান বিজয়।

এ দিনজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নাথান ঢাকায় কয়েক মাস ছিলেন। বাসাবোয় আনিসুর রহমান বাসাটি নাথান বমকে ভাড়া করে দেন। আমাদের অভিযান শুরুর পর তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে যান।

সোমবার (২৩ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিজেদের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আনিসুর রহমানের সঙ্গে নাথান বমের যোগাযোগ ছিল। ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন তারা। নাথান বম বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশের মিজোরামে অবস্থান করছেন বলে র‍্যাবকে জানিয়েছেন আনিসুর রহমান।

র‍্যাব জানায়, নাথান লনচেও বম ঢাকায় অবস্থানকালে ২০২২ সালের অক্টোবরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিযান শুরু করে। এ সময় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ঢাকায় তিনি যে বাসায় অবস্থান করছিলেন সেটি ২০ হাজার টাকায় ভাড়া করা ছিল।

খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এ তথ্য জানতে পারে। যার ভিত্তিতে সোমবার (২৪ জুলাই) ভোর ৩টার দিকে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০’র একটি আভিযানিক দল লৌহজং এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তার আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির। তিনি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের একটি সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি হুজির সদস্য ছিলেন। পরে তার সঙ্গে কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে আনসার আল ইসলামের রক্সি ও ফেলানীর পরিচয় হয়। পরে তারা যাত্রাবাড়ীতে একটি মিটিং করে নতুন একটি সংগঠন তৈরি ও বিস্তারের পরিকল্পনা করে। এরপর শুরু হয় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কার্যক্রম।

জঙ্গি সংগঠনের আমির মাহমুদ কে?
আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ২০১৬ সালের পর বিভিন্ন সময় তিনি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ২০২০ সালে বান্দরবানের গহীন এলাকায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে যান তিনি। বান্দরবানে আসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছে প্রায় এক মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালনা, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ নেন। কুমিল্লার প্রতাপপুরে নিজের বাড়িসহ জমি এক ব্যক্তির কাছে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন মাহমুদ। জমি বিক্রির কিছু টাকা সংগঠনে দানও করেন। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে ৩ বিঘা জমি কিনে করে ওই বছরই সেখানে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি পোল্ট্রি ফার্ম, চাষাবাদ ও গবাদি পশুর খামার পরিচালনা করতেন।

মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব জানায়, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আগে আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালে রক্সি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলে সংগঠনের অন্যান্য সূরা সদস্য ও সদস্যদের সিদ্ধান্তে মাহমুদকে আমির হিসেবে নির্বাচন করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের সময় মাহমুদের সঙ্গে কেএনএফ সদস্যদের পরিচয় হয়। কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয় মাহমুদের। ২০২১ সালে কেএনএফ’র ছত্রছায়ায় বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে তাদের মধ্যে চুক্তি হয়।

সংগঠনের অর্থায়নে বাসাবো এলাকায় নাথান বমকে বাসা ভাড়া করে দেন মাহমুদ
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, দুই সংগঠনের মধ্যে চুক্তি ছিল জামাতুল আনসারের সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেবে কেএনএফ। প্রতিমাসে কেএনএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও খাবার খরচ বাবদ ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বহন করা হতো। আমির মাহমুদের নির্দেশনায় দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হতো। সংগ্রহকৃত অর্থ দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের খরচ ও সারা দেশে অন্যান্য সাংগঠনিক কাজের জন্য অর্থ প্রদান করা হতো। এছাড়া, তার নির্দেশনায় কেএনএফ থেকে ১৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরণের ভারী অস্ত্র ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় করা হয় যা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আমির মাহমুদের নির্দেশনায় কেএনএফ প্রধান নাথান বমকে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় সংগঠনের অর্থায়নে একটি বাসা ভাড়া করে দেওয়া হয় যেখানে তিনি পরিবারসহ মাঝে মধ্যে অবস্থান করত।

মাহমুদের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে আনসার হাউজ তৈরি এবং পরিচালিত হতো। ভুল বুঝিয়ে কিছু সদস্যকে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হতো। প্রশিক্ষণ চলাকালীন তারা এ ব্যাপারে অসম্মতি জানানো ও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মাহমুদের নির্দেশনায় তাদের শাস্তিস্বরূপ নিজস্ব তৈরি জেলখানায় বন্দি করে রাখা হতো। পরে প্রশিক্ষণরত সদস্যদের কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বা বিদ্রোহ করলে গুলি করে হত্যার ঘোষণাও দেন মাহমুদ।

মেজর জিয়ার সঙ্গে একাধিক সাক্ষাৎ
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আমির মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি মেজর জিয়ার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে একটি মিটিংয়ে আমির মাহমুদের সঙ্গে সংগঠনটির একটি চুক্তি সই ও তাকে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। পরে আরও অর্থ দেওয়ার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী জামাতুল আনসারের সদস্যদের আনসার আল ইসলাম আইটি ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে। বিনিময়ে আনসার আল ইসলামের সদস্যদেরকে জামাতুল আনসার পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করবে। এ বিষয়ে মাহমুদ কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জানান ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় করেন।

পাহাড়ে অভিযান শুরু করলে আত্মগোপন
পার্বত্য অঞ্চলে র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর অভিযান শুরু হলে আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ পাহাড় থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন। সংগঠনকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য তিনি পলাতক সূরা সদস্য ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে; ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেন। খন্দকার মইন বলেন, কেএনএফের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। নাথান বম পার্শ্ববর্তী দেশের মিজোরামে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সময়ে কেএনএফের হামলা ও আক্রমণের বিষয়ে তার ইন্ধন থাকতে পারে। টাংগাইল, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনের পর ৭-১০ দিন আগে তিনি মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের একটি বাসা ভাড়া নেন মাহমুদ। তার সংগঠনের বেশকিছু সদস্য নিয়মিত ওই বাসায় আসা-যাওয়া করত। নিরাপত্তার জন্য তিনি সবসময় তার সঙ্গে দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী রাখতেন।

২০০৪ সাল থেকে হুজি সদস্য ছিলেন কাজী সরাজ
মাহমুদের দেহরক্ষী কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ স্থানীয় একটি পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষে পটুয়াখালীতে ব্যবসা করতেন। তিনি ২০০৪ সালে জঙ্গি সংগঠন হুজিতে যোগ দেন। হুজির কার্যক্রম স্তিমিত দেখে ২০১৪ সালে তিনি আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরে ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার শাওনের মাধ্যমে তিনি জামাতুল আনসারে যোগ দেন। তিনি পটুয়াখালী ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে বেশ কয়েকজনকে সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

সিরাজ ইলেকট্রিক্যাল কাজ ও তথ্য প্রযুক্তিতে পারদর্শীদের বাছাই করে সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এছাড়াও তিনি সংগঠনের নতুন সদস্য যারা ঢাকায় আসত তাদের দেখাশোনা করতেন। প্রশিক্ষণের জন্য তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাঠাতেন। পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান শুরু হলে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে যান। পরে আমির মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুন্সিগঞ্জের ভাড়া বাসায় অবস্থান করতে থাকেন।

সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে মাহফুজুর
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আরও জানান, মাহমুদের দেহরক্ষী মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি সিলেটের জগন্নাথপুরে একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। সে ২০১৮ সালে আগে গ্রেপ্তার সূরা সদস্য রনবীরের মাধ্যমে এ সংগঠনে যোগ দেন ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি সিলেট অঞ্চলে দাওয়াতি শাখার আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন। সিলেট অঞ্চলের যোগদান করা সদস্যদেরকে ভুল বুঝিয়ে তথাকথিত জিহাদ ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বিভিন্ন সময় সংগঠনের বৈঠক আয়োজন করতেন। তার মাদরাসায় সংগঠনটির সূরা কমিটির একাধিক বৈঠক হয়েছে। এছাড়াও প্রবাসে অবস্থানকৃত তার আত্মীয়-স্বজন থেকে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন।

পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান শুরু হলে মাহফুজুর রহমান ৭ মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে আনসার হাউজে আত্মগোপন থাকেন। পরে আমির মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুন্সিগঞ্জের ভাড়া বাসায় অবস্থান করতে থাকেন।

গ্রেপ্তার এ তিনজনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা চলমান বলেও জানান র‌্যাপিড লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

কালের আলো/ডিএস/এমএইচএ