নেশা: ধ্বংস করে সুখি সমৃদ্ধ পরিবার
প্রকাশিতঃ 10:52 am | August 19, 2023
মাহমুদ আহমদ:
বিভিন্ন প্রকারের মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে এক শ্রেণির যুবকদের জীবন ধ্বংসের দিকে। এছাড়া অনেকেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। কিশোর-কিশোরিদের মধ্যে এখন নেশায় জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। সব সংঘাত সংঘর্ষের চিরন্তন ও মহাসমন্বয় হচ্ছে ইসলাম। জীবনাদর্শ, জীবন ব্যবস্থা ও জীবন বিধান হিসেবে ইসলামে রয়েছে সব সমস্যার সঠিক সমাধান। এতে রয়েছে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি সমস্যার সমাধান আর মৃত্যুর পর আখেরাতের অনন্ত জীবনে নিশ্চিত সুখ-শান্তি লাভের উপায়।
ইসলাম মানুষের চলার পথের সন্ধানদাতা, উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন তথা মানবজীবনের চরম লক্ষ্য হাসিলের একমাত্র পন্থা। এর ব্যাপ্তি জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধিকার। তাই ইসলাম মানুষের সঠিক পথের দিশারী, দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বাঙ্গীন ও পূর্ণাঙ্গ একমাত্র জীবন ব্যবস্থা।
শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপনের জন্য আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তাকে বৈধ করেছেন আর যা ক্ষতিকর তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তেমনিভাবে মদ ও জুয়া মানুষের জন্য ক্ষতি ও ধ্বংস ছাড়া কিছুই বয়ে আনে না আর এ কারণেই আল্লাহ এই পাপ থেকে দূরে থাকার আদেশ করেছেন। জুয়াবাজি একটি ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ। একটি মারাত্মক সামাজিক অপরাধ। জুয়াড়ির জীবন-সংসার কুরে কুরে বিনষ্ট হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম। এ ব্যাপারে কোনো আলেম দ্বিমত পোষণ করেননি।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং মহানবি (সা.)-এর আগমনের সময় তৎকালীন মক্কায় নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল এবং মদ ও জুয়ায় তারা মত্ত থাকত। কোরআনে মদ ও জুয়াকে ঘৃণ্য বস্তু এবং শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। এগুলো থেকে দূরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। মদ-জুয়ার মাধ্যমে পরস্পর শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। উপরন্তু এগুলোর মাধ্যমে শয়তান মানুষকে নামাজ ও আল্লাহতায়ালার স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে। মদ-জুয়া হারাম হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই।
বর্তমান সমাজে লটারি, হাউজি, বাজি ধরা, চাক্কি ঘোরানো, রিং নিক্ষেপ প্রভৃতি নামে নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন রয়েছে। এগুলো কখনও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। জুয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়াকে হারাম এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। তুমি বল এ দুটোতে রয়েছে মহাপাপ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৯)। এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ আছে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবি (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মদ, জুয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (বায়হাকি ও মিশকাত)।
জুয়া সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে অপর এক স্থানে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! নিশ্চয় মাদক দ্রব্য, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারণী তীর হলো অপবিত্র ও শয়তানী কার্যকলাপ। অতএব তোমরা এগুলো থেকে একেবারে দূরে থাক যেন তোমরা সফল হতে পার।
মাদক দ্রব্য ও জুয়ার মাধ্যমে শয়তান তোমাদের মাঝে কেবল শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহকে স্মরণ করা ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি এসব থেকে বিরত হবে?’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৯০-৯১) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়ায় অংশগ্রহণকারী, খোটাদাতা ও মদ্যপায়ী জান্নাতে যাবে না’ (দারেমি ও মিশকাত)।
অজ্ঞতার যুগে শুধুমাত্র ধন-সম্পদের ওপরেই জুয়া হত না, বরং কখনো কখনো স্ত্রীদেরকেও জুয়ার সওদা হিসেবে পেশ করা হত। অজ্ঞতার যুগে নানা রকমের জুয়ার প্রচলন ছিল। তন্মধ্য আরবে প্রচলিত ভাগ্য নির্ধারণী জুয়া খেলার প্রথা সূরা মায়েদায় বর্ণিত হয়েছে। তার পদ্ধতি ছিল, দশ ব্যক্তি শরীক হয়ে একটি উট যবাই করত। অতঃপর এর গোশত সমান দশ ভাগে বন্টন করার পরিবর্তে জুয়ার আশ্রয় নেয়া হত।
দশটি তীরের সাতটিতে বিভিন্ন অংশবিহীন চিহ্ন দেয়া থাকত। অবশিষ্ট তিনটি তীর অংশবিহীন সাদা থাকত। এ তীরগুলোকে তুনের মধ্যে রেখে নাড়াচাড়া করে নিয়ে একেক অংশীদারের জন্য একটি তীর বের করা হত। যত অংশবিশিষ্ট তীর যার নামে বের করা হত, সে তত অংশের অধিকারী হত। আর যার নামে অংশবিহীন তীর হত, সে বঞ্চিত হত। শুধু বঞ্চিত নয়, বরং বঞ্চিত ব্যক্তিকে উটের পূর্ণ মূল্য পর্যন্ত দিতে হত। আরবিতে এ পদ্ধতিকেই কিসাম বিল আযলাম বলা হয় যা হারাম।
এ যুগে সব ধরনের মন্দ কাজ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা অনেক কঠিন বিষয় হলেও আমাদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এসব মন্দকাজ থেকে দূরে থাকা। মাদক সমাজকে গ্রাস করছে। যতই দিন যাচ্ছে ভয়াবহতা ততই বাড়ছে। মাদকের এই বিভীষিকাময় থাবা থেকে আমাদের যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
লটারি, জুয়া খেলাকে আনন্দ মনে হলেও এর সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভাব ভয়ংকর। কোরআনে করিম বিভিন্ন আয়াতে জুয়াকে অকাট্যভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। এমনিভাবে ঘোড়াদৌড়েও জুয়ার প্রচলন ছিল। দু’ব্যক্তি ঘোড়াদৌড়ের প্রতিযোগিতা লাগাত এবং পরস্পরে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হত, যে পরাজিত হবে সে বিজয়ী ব্যক্তিকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে।
মহানবি (সা.) একেও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত করে হারাম ঘোষণা করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ) হাদিস থেকে জানা যায় যে, মহানবি (সা.) জুয়া পরিহার করার প্রতি এতো গুরুত্বারোপ করেছেন যে, শুধু জুয়াকেই হারাম করেননি বরং জুয়ার ইচ্ছা প্রকাশকেও গুনাহ সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তি অপরকে জুয়ার প্রতি আহ্বান করবে, তাকে তার এই গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ লাত-উজ্জার শপথ ইত্যাদি বললে, তবে সে যেন সঙ্গে সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। আর কেউ যদি অন্যকে প্রস্তাব দেয়, এসো আমরা জুয়া খেলি, সে যেন (জরিমানাস্বরূপ) দান-সদকা করে’ (বোখারি, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।
বর্তমান যুগে বিশ্বময় এই যে মদ ও জুয়ার ব্যাপকতা তা মূলত হওয়ারই কথা। কেননা শেষ যুগের লক্ষণাবলি আজ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। শেষ যুগে এসবের ব্যাপক প্রসার হবে আর একজন মুমিন এসব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে। যেমন বোখারি শরিফে উল্লেখ রয়েছে- মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও দলাদলি, মিথ্যা ও দুর্নীতির সর্বগ্রাসী প্রাদুর্ভাব, ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টান তথা দাজ্জালের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন। সুদ, মদ, জুয়া ও ব্যভিচারের ছড়াছড়ি।
আকাশের আবরণ উন্মোচিত। মহাকাশ বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি। বন্য জীবজন্তু জড়ো করে দেশে দেশে চিড়িয়াখানা স্থাপন। পুস্তক-পুস্তিকার ব্যাপক প্রকাশনা। নর্তকী ও গায়িকাদের প্রাধান্য। উঁচু উঁচু অট্টালিকা নির্মাণের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ যুগে সব ধরনের মন্দ কাজ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা অনেক কঠিন বিষয় হলেও আমাদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এসব মন্দকাজ থেকে দূরে থাকা। মাদক সমাজকে গ্রাস করছে। যতই দিন যাচ্ছে ভয়াবহতা ততই বাড়ছে। মাদকের এই বিভীষিকাময় থাবা থেকে আমাদের যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।