স্মার্ট পুলিশকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়
প্রকাশিতঃ 10:45 am | September 16, 2023
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
ক্ষমতাসীনরা আক্রান্ত বলেই আজ পুলিশের এডিসি হারুন বিষয় নিয়ে এত কথা? এই সহজ সরল প্রশ্নের উত্তর- হ্যাঁ। ছাত্রলীগের দুই নেতাকে শাহবাগ থানায় বেধড়ক পেটানো, দাঁতে উপড়ে ফেলার ঘটনায় এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে। আহত ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক ওই দিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের তিন নেতাকে ডেকে নেন। তিনি বারডেম হাসপাতালে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এডিসি হারুনকে দেখতে পেয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরে হারুনের নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতাদের শাহবাগ থানায় নিয়ে তাদের দাঁত উপড়ে ফেলা হয়।
প্রথমে প্রত্যাহার, তারপর বদলি, এরপর বরখাস্ত এবং সবশেষ রংপুর রেঞ্জে বদলি। এর অর্থ হলো এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগ মূলত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এডিসি হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ অনেক আগে থেকেই। গত কয়েক বছরে, এডিসি হারুন তার সহিংস আচরণের বহু নজির রেখেছেন। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, বিরোধী দলের সদস্যসহ যারা কোনো পাবলিক ইস্যু নিয়ে কথা বলতে রাস্তায় নেমেছেন তিনি তাদের ওপর হামলা করেছেন। গত বছর ঠিক এই সময়ের পত্রিকা ঘাটলেও এরকম দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।
এবার সরকারের শ্লোগান স্মার্ট বাংলাদেশ। দেশ স্মার্ট হবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্মার্ট হতে হবে পুলিশকেও। কিন্তু সেই স্মার্টনেস শুধু কাপড়ে চোপড়ে নয়, ঝা চকচকে অফিস দিয়ে নয়, বড় বড় গাড়ি দিয়ে নয়, শুধু ক্ষমতা বাড়িয়ে নয়। স্মার্ট পুলিশকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়, জনগণের প্রতি নমনীয় হতে হয় এবং কাজের প্রতি ন্যায্যতা দেখাতে হয়।
থানায় তুলে এনে শারীরিক নির্যাতন করা ফোজদারি অপরাধ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ছাত্রলীগ এজন্য মামলা করেনি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনারের সাথে দেখা করার পর বলেছিলেন, তারা বিভাগীয় ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চান, মামলা করতে চান না। মামলা করবে না ছাত্রলীগ, কারণ তার পুলিশি পাহাড়ার প্রয়োজন আছে। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একটা বিরাট অংশ ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িত, পুলিশকে খেপালে সেখানেও সমস্যা আছে।
এখানে বেশ কিছু অন্যায় সংঘটিত হয়েছে। আগেই বলেছি যে, ছাত্রলীগ নেতাদের ধরে এনে পেটানো ফৌজদারি অপরাধ। এখানে রাষ্ট্রপতির এপিএস বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, হারুনও সরকারি কর্মকর্তা। তারা নিজেরা মারামারি করেছেন আরেক সরকারি কর্মকর্তা সানজিদাকে কেন্দ্র করে যিনি আবার এপিএস সাহেবের স্ত্রী। তাদের এই আচরণ সরকারি চাকুরি বিধি ও নৈতিকতা পরিপন্থী। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও আমাদের আইনে ফৌজদারি অপরাধ। সেই বিচারে এডিসি হারুন ও সানজিদার বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আবার দুইজন মানুষের ব্যক্তিগত ইস্যুতে একজনের ডাকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াও ছাত্রলীগ নেতাদের অন্যায় আচরণ।
দলের শাসন হতে আইনের শাসনে উত্তরণ ঘটাতে জনবান্ধব পুলিশ প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশ ব্যবহৃত হলে সমাজবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা, নিয়জেই অপরাধী হয়ে উঠে। সেই দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। এবং শাস্তি না হলে এর প্রবণতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
বিভাগীয় শাস্তির নামে পুলিশ তর সদস্যদের আপরাধের যেসব শাস্তি দেয় তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে। মানুষ মনেই করে যে, গুরুতর অপরাধেও দেয়া হয় লঘু দণ্ড। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধ করেও শাস্তি পেতে হয় না। সবচেয়ে বড় সমস্যা পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেক ফৌজদারি অপরাধের বিচারও করা হয় বিভাগীয় আইনে যা অপরাধ হ্রাসে সত্যিকারে কোনো ভূমিকা রাখে না। মূলত অপরাধ আড়াল করার জন্যই অভিযুক্তদের বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার কথা বলা হয়।
ছাত্রলীগ আর এডিসি হারুন কাণ্ডে মহানগর পুলিশের ভিতরকার বিভিন্ন স্তরের শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের বিষয়টিও আলোচনায় আছে। ঘটনার পরপরই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সেদিন বারডেম হাসপাতালে রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকই প্রথমে এডিসি হারুন অর রশীদের ওপর হামলা করেছিলেন। এটাও তদন্ত হওয়া উচিত।
এ বক্তব্যর বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, হারুন এই তথ্য কোথায় পেয়েছেন, সেটা হারুন বলতে পারবে। সানজিদা যে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন, পুলিশ কমিশনার মনে করেন সেটিও নিয়ম বহির্ভূত, কারণ কথা বলতে ঊধ্র্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। এই পুরো বিষয়টিতে চেইন অব কমান্ডের দুর্বলতা দৃশ্যমান হয়।
অতিমাত্রায় বল প্রয়োগের প্রবণতা আছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। সেই সাথে আছে অপরাধ প্রবণতা। কোনো বড় ঘটনা ঘটলে এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই বদলি, প্রত্যাহার, ক্লোজ বা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দেয়া হয়। এসব শাস্তিতে কোনো প্রভাবই পড়ে না পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে বড় শাস্তি পেতে হয় না অভিযুক্তকে। ফলে প্রচলিত এই শাস্তি পুলিশের অপরাধ কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। পুলিশ বিভাগের নীতি নির্ধারকদের এ নিয়ে ভাবতে হবে।
পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধ পুলিশই তদন্ত করছে। ফলে কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে না। উন্নত বিশ্বে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে আলাদা কমিশন করে তার বিচার করা হয়। বাংলাদেশেও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন বা নির্বাচন কমিশনের মতো স্বাধীন কমিশন গঠনের ব্যাপারে মত দিয়েছেন তারা। এতে অপরাধ অনেকাংশে কমবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এবার সরকারের শ্লোগান স্মার্ট বাংলাদেশ। দেশ স্মার্ট হবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্মার্ট হতে হবে পুলিশকেও। কিন্তু সেই স্মার্টনেস শুধু কাপড়ে চোপড়ে নয়, ঝা চকচকে অফিস দিয়ে নয়, বড় বড় গাড়ি দিয়ে নয়, শুধু ক্ষমতা বাড়িয়ে নয়। স্মার্ট পুলিশকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়, জনগণের প্রতি নমনীয় হতে হয় এবং কাজের প্রতি ন্যায্যতা দেখাতে হয়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেশিভিশন।