ডিএমপি কমিশনারের ‘মিট দ্য প্রেস’; দেশপ্রেমের শাণিত শপথে পথের দিশা

প্রকাশিতঃ 8:38 pm | October 02, 2023

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

মাত্র দু’দিন আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৩৬তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সোমবার (২ অক্টোবর) প্রথম ‘মিট দ্য প্রেস’। যেখানে নিজের প্রাজ্ঞ অভিব্যক্তির সঙ্গে দায়িত্বশীলতার শাণিত শপথ আর সময়ের প্রতিটি স্পন্দনের ঘটমানতাকে তিনি সামনে তুলে এনেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ট্র‍্যাডিশনাল ক্রাইম থেকে ডিএমপির ক্রাইম পুরোপুরি আলাদা। জনবহুল ঢাকায় পুলিশিং একটি জটিল চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন।

সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অপরাধী ছোট বা বড় হোক, ছাড় নয় কাউকেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে পুলিশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেছেন। যুগোপযোগী পুলিশিং নিশ্চিতে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি তিনি জোরদার করতে চান বিট পুলিশিং কার্যক্রমও। ‘সেফার ঢাকা, বেটার ঢাকা’ নির্মাণের জন্য করতে চান লড়াই। সেবার মান বাড়াতে চান ডিএমপির প্রতিটি থানায়। এজন্য ঘোষণা দিয়েছেন ‘মেসেজ টু কমিশনার’ হটলাইন চালু করার। যার মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে সেবা না পেলে সরাসরি কমিশনার বরাবর মেসেজ দিতে পারবেন। তিনি প্রত্যাশা করেছেন রাজধানীবাসীর পাশাপাশি সাংবাদিকদের সহযোগিতাও।

রাজধানীর মিন্টু রোডে ডিএমপি মিডিয়ার সেন্টারে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি সদস্যদের কড়া বার্তা দিয়ে নতুন এই কমিশনার বলেছেন, ‘দেশে আদালত, বিচারিক প্রক্রিয়া আছে। যেসব অপরাধী জেল থেকে বের হচ্ছে তাদের কঠোর মনিটরিং করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধী ছোট হোক বড় হোক, কাউকে ছাড় নয়।’

  • যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে পুলিশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই
  • জোরদার করতে চান বিট পুলিশিং কার্যক্রম
  • ‘সেফার ঢাকা, বেটার ঢাকা’ নির্মাণের জন্য করতে চান লড়াই
  • সেবার মান বাড়াতে চান প্রতিটি থানায়। ঘোষণা দিয়েছেন ‘মেসেজ টু কমিশনার’ হটলাইন চালু করার।
  • রাজধানীবাসীর পাশাপাশি সাংবাদিকদের সহযোগিতার প্রত্যাশা

নতুন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ এসব বক্তব্য কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও নেতৃত্বের নন্দিত মহিমায় গোটা ডিএমপিকে উদ্ভাসিত করতে পালন করবে প্রভাবকের ভূমিকা। সব রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সাফল্যের স্বর্ণদুয়ারে নিয়ে যাবে ডিএমপিকে, এমনটিই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য হচ্ছে- বাংলাদেশ পুলিশে সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব হাবিবুর রহমানের বক্তব্যে ফুটে ওঠেছে দেশ ও ডিএমপি’র জন্য দায়বোধ, অপরিমেয় ভালোবাসা ও গভীর মমত্ববোধ। পরমতসহিষ্ণুতা, প্রসন্নতা ও সামাজিক অগ্রগতিতে বিশ্বাসী এই মানুষটির বক্তব্যে হৃদয়ানুভূতি বা কঠোরতাও রয়েছে।

কী চ্যালেঞ্জ মনে করেন ডিএমপি কমিশনার?
‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পরিসংখ্যানটি নিজেই উপস্থাপন করলেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। বললেন, ‘ঢাকা শহরে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭৩ হাজার মানুষ বসবাস করে। এই শহরে পুলিশিং একটি জটিল চ্যালেঞ্জ। তারপরও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নানা ধরনের সমস্যার সমাধান করে আসছে পুলিশ। আমার আগে বিভিন্ন সময় যারা কমিশনার ছিলেন, তারা বিভিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। তাদের কার্যক্রমের গতিশীলতা ধরে রেখে কাজ করবো।’ তাছাড়া ঢাকার যানজটও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মানছেন তিনি। তবে স্পট ধরে ধরে সমাধান করতে চান যানজট সমস্যার।

এই প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা নিঃসন্দেহে ট্রাফিক। ক্রমবর্ধমান গাড়ির চাপ, রাস্তার স্বল্পতা এবং জনসংখ্যার চাপ দিন দিন ট্রাফিক কমানো যাচ্ছে না। আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে তা প্রয়োগ করতে চাই। বাস স্টপে এসে বাসগুলো রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে, এটি সচেতন করতে হবে। এজন্য চালকদেরকে ট্রেনিং দেওয়া হবে তাদেরকে নিয়ে কর্মশালা করা হবে। যাতে তারা এই কাজগুলো না করে।’

তিনি বলেন, ‘পথচারী পারাপারের সময় অনেক গাড়ি স্লো হয়ে যানজট হয়ে যায়। অনেক সময় রাস্তার মাঝ দিয়ে নারী-শিশু দৌড়ে পারাপার হয়। আমি ডিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদান করার পরে প্রথমেই মিটিং করেছি ট্রাফিকের সঙ্গে। ট্রাফিক সমস্যা সমাধানে সবার সহযোগিতা চাই।’

‘প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে অপরাধের গতিধারাও পরিবর্তন হয়েছে। সব বিষয় পর্যালোচনা করে পুলিশ কাজ করছে উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই সময়টাতে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি হয়ে থাকে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। ২ কোটি ২৪ লাখ মানুষের জন্য ৩৪ হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছে; যা নিতান্তই কম। তারপরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ।’

থানায় সেবার মান বাড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ডিএমপির থানাগুলোতে সেবার মান বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকা শহরকে বাংলাদেশ পুলিশের মডেল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের কথা উঠে থাকে। থানায় গিয়ে কেউ যদি স্যাটিসফাই না হন, তাহলে ঊর্ধ্বতনও কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ঢাকা নগরবাসীর একটি লোকও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে বঞ্চিত থাকবে না, সেটা হতে দেওয়া হবে না— এটাই আমাদের প্রত্যয়।

‘মেসেজ টু কমিশনার’ হিসেবে একটি হট নম্বর চালু করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিধিমালা তৈরি করে পরবর্তী সময়ে নম্বরটি ঘোষণা করা হবে। নগরবাসীর সমস্যা বুঝে সহায়তা করা হবে। যেকোনও অভিযোগ আসলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

টাস্কফোর্স তৈরি করে ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা
রাজধানীতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ছিনতাই ঘটনা প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে সে বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতোমধ্যে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে পুলিশের প্রচেষ্টা রয়েছে। একটি টাস্কফোর্স তৈরি করে ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সড়কে জ্বলবে সিগনাল বাতি
সব উন্নত শহরে ট্রাফিক বাতি রয়েছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে এবং কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন হয়েছে। খুব অল্প দিনের ভেতরে ট্রাফিক বাতি চালু করা হবে। যাতে সিগন্যাল বাতি অনুযায়ী ট্রাফিক কার্যক্রম করা যায়। ঢাকা শহরে যে ট্রাফিক সমস্যা তা ট্রাফিক পুলিশ একার পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। ঢাকা শহরে কিছু উন্নয়ন কাজ চলছে। এই উন্নয়ন কাজ শেষ হলে অনেকাংশেই ট্রাফিক সমস্যা কমে যাবে। আগে কেউ চিন্তা করতে পারত না এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট ১০ মিনিটে আসতে পারবে। এখন তা সম্ভব হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ যে পরিমাণ কষ্ট করে রোদের মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, রমজান মাসেও তারা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ইফতার করে। সেই বাস্তবতাও রয়েছে। খুব অল্প দিনের মধ্যে ট্রাফিক বাতির মাধ্যমে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা হবে।

অবৈধ স্থাপনা ক্লিয়ার করে রাস্তা চলাচল স্বাভাবিক
অবৈধ স্থাপনা ক্লিয়ার করে রাস্তা চলাচল স্বাভাবিক রাখার প্রতিশ্রুতি জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘পুলিশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী সব ধরনের কাজ করে যাবে। আমরা আইনের প্রয়োগ করতে চাই। কোন সংগঠন যদি রাস্তায় বা ফুটপাতে অফিস করে থাকে সরকারি জায়গার ভিতরে সে সংগঠনকে কোন অবস্থাতেই সেখানে আমরা রাখতে দিতে চাই না।

আরো কিছু কিছু সমস্যা জানা আছে। ট্রাফিকেও কিছু বিষয় রয়েছে সমস্যা রয়েছে। সড়কে চালকদের অসচেতনতা দূর করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পথচারী পারাপারের কারণেও সড়কে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। আমি যোগদান এরপর ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের সাথে আমি প্রথম মিটিং করেছি। এজন্য সবার সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চাই আমরা।

গুজবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান
গুজবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান রাজধানীর এই পুলিশপ্রধান। গুজব নিয়ে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে, তা অনেকের জানা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার এক ধরনের জবাবদিহিতা রয়েছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ালে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের বাইরে থেকে গুজব ছড়ানো হয়। আমাদের সিস্টেমের ভেতরে যেগুলো রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। আসন্ন দুর্গাপূজায় রাজধানীতে ২২০টির মতো পূজা মণ্ডপ রয়েছে। এগুলোর নিরাপত্তায় প্রতিটি পুলিশ সদস্য কাজ করবে।সাইবার পেট্রোলিং জোরদার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আশা করি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না।’

মাদক নিয়ন্ত্রণের সবাইকে সম্পৃক্ত করতে চান
মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু পুলিশ নয়, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নামে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর রয়েছে উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘বাংলাদেশে মাদক ইয়াবা তৈরি হয় না। এটি বাইরের দেশ থেকে আসে। তবে ভেতরে যেসব ইয়াবা রয়েছে, সেগুলো জব্দে কাজ করে পুলিশ। এমন একটি ছোট ট্যাবলেট, যা সহজে বহনযোগ্য। সমাজে যেসব স্বনামধন্য বক্তি আছেন, মাদকের চাহিদা কমানোর জন্য কী করা উচিত— সে বিষয়ে সবাই কাজ করবেন বলে আমি আশা করি। মাদক নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান ডিএমপি কমিশনার।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে চিন্তা নেই
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেন নতুন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। ‘একটি রাষ্ট্র থেকে ভিসানীতির ঘোষণা এসেছে। পুলিশ নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে যদি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে তাহলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। এটা নিয়ে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে কোনো ধরনের প্রভাব বা আতঙ্ক রয়েছে কি না। থাকলে আপনারা মনোবল চাঙ্গার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?’-গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি নির্বিঘ্নে বলতে চাই। একটি দেশের ভিসানীতি কি হবে এটি তাদের বিষয়। এটা নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের চিন্তার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমি কোনো দিন… একটি দেশের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, আমি কোনো দিন ওই দেশে যাই নাই, আমার যাওয়ার ইচ্ছাও নেই। উনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, আমি যোগদান করে আমার পুলিশের ভেতরে এরকম কোনো চিন্তার বিষয় দেখি নাই। এটি একটি পর্যায়ের ব্যবস্থা। সংগঠন পর্যায়ের কোনো ব্যবস্থা নয়। সংগঠন হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সবসময়ই ঢাকাবাসীর জন্য এবং ঢাকার জনগণের জন্য, নিরাপদ ঢাকার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারা (পুলিশ) এগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা করে না।

কালের আলো/এমএএএমকে