দৃঢ় হোক বন্ধন
প্রকাশিতঃ 9:50 am | October 06, 2023
মাহমুদ আহমদ:
আত্মীয় এবং প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ়করণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘এবং তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না এবং সদয় ব্যবহার কর পিতা-মাতার সাথে, আত্মীয়স্বজন এবং এতিম এবং মিসকিন এবং আত্মীয় প্রতিবেশী এবং অনাত্মীয় প্রতিবেশীগণের সাথে এবং সঙ্গী সহচর এবং পথচারীগণের সাথে এবং তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে, তাদের সাথে। আল্লাহ তাদেরকে আদৌ ভালোবাসেন না যারা অহংকারী দাম্ভিক’ (সুরা নেসা, আয়াত: ৩৬)।
এখানে আল্লাহতায়ালা আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছেন, আমরা যেন নিজেদের ভাই, আত্মীয়স্বজন, আপনজন এবং প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করি, তাদের সাথে সহযোগিতা করি, তাদের প্রয়োজন হলে সাহায্য করি, যতদূর সম্ভব তাদের কল্যাণ পৌঁছাই এবং এমন সব লোকদেরও সাহায্য করবো যাদের আমরা জানি না, কেননা যদিও তাদের সাথে আমাদের কোনো প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, অল্প সময়ের জন্য সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদেরও যদি কোনো প্রকার সাহায্যের প্রয়োজন হয়, আমাদের সাহায্য করতে হবে।
একজন মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় রাখা এবং প্রতিবেশীর সুবিধা অসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা। এক প্রতিবেশী দ্বারা অন্য প্রতিবেশীর যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয় তা সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। হোক না আমার প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মের বা অনুসারী, আমার মত ও পথের সাথে তার মিল নাও থাকতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার আচরণ খারাপ হবে? মোটেও নয়।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার অনেক ফজিলতও রয়েছে। কেননা আত্মীয়তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা, তাদের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের কাছে আসা-যাওয়া করা ইবাদতেরই অংশ। যেমন মহানবি (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি তার রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সময় পিছিয়ে দেওয়া কামনা করে, তার উচিত আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা’ (বুখারি)। হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি মহানবি (সা.) কে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমাকে এমন আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে, তখন তিনি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর এবাদত কর, তার সাথে কোনো কিছু শরিক করো না। নামাজ ভালো করে আদায় কর এবং জাকাত দাও আর আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখ’ (বুখারি)।
কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলেও আমার উচিত হবে সেই সম্পর্ক বজায় রাখা। এ বিষয়ে মহানবির (সা.) শিক্ষা হলো- তিনি (সা.) বলেন: ‘সমান সমান আচরণ দ্বারা সম্পর্ক স্থাপনকারী হওয়া যায় না। কিন্তু, তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে, তখনও যদি সে সম্পর্ক ঠিক রাখে, তাহলেই তাকে প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনকারী বলা যাবে। অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক পূর্ণ বজায় রাখা তখনই হবে, যখন কোনো সম্পর্ক ছিন্ন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখা হবে।’ (বুখারি)।
আত্মীয়রা যখন আমাদের সঙ্গে অন্যায় করবে, দুর্ব্যবহার করবে তখনও তাদের সঙ্গে অন্যায় কিংবা দুর্ব্যবহার করা যাবে না। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয়, যে সম্পর্ক রক্ষাকারীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে; বরং প্রকৃত সম্পর্ক রক্ষাকারী সে, যে সম্পর্ক ছিন্নকারীরর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে’ (বুখারি)। অপরদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের সম্পর্কে মহানবির (সা.) ভয়াবহ সতর্কবাণীও রয়েছে। তিনি (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি)।
আমরা যদি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের শিক্ষার ওপর আমল করি তাহলে একটি চমৎকার ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সবাই একে অপরের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থেকে বসবাস করবে। একে অন্যের উপকার করার চেষ্টা করবে, প্রত্যেকের অধিকার প্রত্যেকে আদায় করতে চেষ্টা করবে। ইসলামে যেসব অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আত্মীয় এবং প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে অধিক মাত্রায় তাগিদ করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য ঘোষণা করেছেন আর এ ব্যাপারে হাদিসেও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জিব্রাইল এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। আমার মনে হলো হয়তো তিনি প্রতিবেশীকে সম্পদের ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।’ (মুসলিম)।
ইসলাম ধর্মে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, কাফেরদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে, আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে। হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি (সা.) উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তুমি স্বীয় মাতার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখবে’ (বুখারি ও মুসলিম)।
ইসলামের অসংখ্য অনুশাসন মেনে চলা সত্ত্বেও কোনো লোক মুমিনের কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না, যদি সে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী হয় এবং প্রতিবেশীদের সাথে সদাচারী না হয়। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, কোনো মুমিন কোনোভাবেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না এবং সেই সাথে তার প্রতিবেশীরও অনিষ্ঠ সাধন করতে পারে না। এ শিক্ষা উপেক্ষা করে কারও পক্ষে পূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। বস্তুত আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং প্রতিবেশীর অনিষ্ট সাধনকারী ব্যক্তিকে ইসলাম মুমিন বলে স্বীকৃতি দিতেই প্রস্তুত নয়।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত নবি করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো কে মুমিন নয় ইয়া রাসুলুল্লাহ? হজরত রাসুল করিম (সা.) উত্তরে বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’ (বুখারি ও মুসলিম)।
তাই একজন মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় রাখা এবং প্রতিবেশীর সুবিধা অসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা। এক প্রতিবেশী দ্বারা অন্য প্রতিবেশীর যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয় তা সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। হোক না আমার প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মের বা অনুসারী, আমার মত ও পথের সাথে তার মিল নাও থাকতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার আচরণ খারাপ হবে? মোটেও নয়।
ধর্মীয় মূল্যবোধে প্রতিবেশীর অধিকার এতো ব্যাপক ও বিস্তৃত যে দৈনন্দিন জীবনের সর্বাবস্থায় প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়ার শিক্ষা ইসলামে রয়েছে। সাহাবাদের লক্ষ্য করে একবার রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা কি জান প্রতিবেশীর হক কি? যদি সে তোমার সাহায্যপ্রার্থী হয় তাকে সাহায্য করবে, যদি সে ধার চায় তাকে ধার দেবে, যদি সে অভাবগ্রস্ত হয় তার অভাব মোচন করবে, যদি সে রোগগ্রস্ত হয় তাকে সেবা দান করবে, যদি তার মৃত্যু হয় জানাজার নামাজে শরিক হবে, যদি তার মঙ্গল হয় তাকে উৎসাহিত করবে, যদি তার বিপদ হয় তাকে সহানুভূতি জানাবে। তার অনুমতি ব্যতীত তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যাতে তার আলো বাতাস বন্ধ হয়। যদি তুমি ফলমূল ক্রয় কর, কিছু অংশ প্রতিবেশীর জন্য পাঠাবে আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তা গোপনে তোমার সন্তানদের খেতে দেবে যেন প্রতিবেশীর ছেলেমেয়ে তার বাবা-মাকে বিরক্ত না করে।
আমার প্রতিবেশী যে কেউ হোক, জাতি ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার সাথে উত্তম আচরণ করার শিক্ষা বিশ্বনবি (সা.) আমাদের দিয়েছেন। তাই সবার সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখা এটা আমার দায়িত্ব।
আসুন, আমরা সবাই সবার আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেই আর তাদের সুখ দুঃখে পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।