রাজনীতিতে খুচরা কথা
প্রকাশিতঃ 10:35 am | October 07, 2023
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
যার মুখে যা আসে বলে দেয়। চিন্তা করে না কথাটা আমাদের কতটা উপকারে আসছে আর কতটা ক্ষতি করছে। সুতরাং বক্তব্য-বিবৃতিতে সতর্ক থাকা উচিত। সময়টা খারাপ। একজন নেতার একটা কথা, একটা উচ্চারণ অনেক ক্ষতি করতে পারে।
তলে তলে আপস হয়ে গেছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার দিল্লি আছে, আমরাও আছি। শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ভারসাম্য করে ফেলেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। যথাসময়ে নির্বাচন হবে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওপরে ওপরে অনেক দ্বন্দ্ব থাকলেও পর্দার অন্তরালে অনেক আলোচনাই হয়, সেগুলো প্রকাশ্যে আসেনা। আসলেও অনেক মার্জিত পরিভাষায় প্রকাশ করা হয়। তলে তলের মতো খুচরা কথা প্রকাশ্যে জনসভায় বলার মত শব্দ নয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, অপশব্দ শুধু মানুষকে নয়, এক সময় নিজেকেও আঘাত করে।
উপরের দুটি বক্তব্যই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদরের। প্রথমটি সংবাদমাধ্যমে আসে ১ অক্টোবর। তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছেন, যেমন করে এর আগে ৬ সেপ্টেম্বরও করেছিলেন। বলেছিলেন, সময়টা খারাপ। কাজেই এবার বেশি করে সতর্ক থাকতে হবে কথা ও বাক্য ব্যবহারে।
যিনি সবাইকে অতি কথন থেকে দূরে থাকতে বললেন, সাবধান হতে বললেন, সেই তিনি কেন ‘তলে তলে, আপস হয়ে যাওয়া, দিল্লি আছে, আমরাও আছির’ মতো কথা বললেন? এখন এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে ট্রল হচ্ছে।
আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে উঠছে রাজনৈতিক নেতাদের আক্রমণাত্মক, ব্যাঙ্গাত্মক শব্দে প্রতিপক্ষকে অশ্রদ্ধা করে উচ্চারিত কথার যুদ্ধ দেখে দেখে। ভাষার কদর্যতায় এগিয়ে যাচ্ছি আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অজান্তেই শেখাচ্ছি সে সব। যখন টিভিতে বাচ্চাদের সামনে এই ভাষা ভেসে ওঠে তখন কী বাবা মা ছাড়া আর কারও খারাপ লাগে? ভাষা ব্যবহারের ক্রমাগত এই অবনয়ন দেখে ভাষাবিদেরা শঙ্কিত হন কিনা জানা নেই।
‘কাউকে মানিনা, ভিসা নীতির পরোয়ানা করিনা’- জাতীয় কথা থেকে হঠাৎ করে আপস হয়ে গেছে, তাও তলে তলে? আবার সাথে টেনেছেন দিল্লিকে যেন সরবে বলতে হবে যে, আওয়ামী লীগ দিল্লির কথাতেই চলে।
ওবায়দুল কাদের যখন এমন উল্লসিত ঠিক তখনই ২৭ সেপ্টেম্বরের একটি বৈঠকের কথা উঠে আসে পত্রিকায়। সেদিন ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান৷ ৩ অক্টোবর হোয়াইট হাউসের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগবিষয়ক সমন্বয়কারী জন কারবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জ্যাক সুলিভানের সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয় নিয়ে কথা বলেন৷ তিনি বলেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করেছেন৷ জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে৷
তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো? বোঝা গেল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তার নিজস্ব অবস্থানেই আছে। অথচ দলের সাধারণ সম্পাদক এক ভিন্ন কথা বললেন। যদি নেতা কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে এমনটা বলে থাকেন তাহলে ভিন্ন কথা। তবে বলতেই হবে যে, এরকম শব্দ ও বাক্য চয়ন আমাদের রাজনীতির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শুধু তাই নয়, এরকম কথা আন্তর্জাতিক কূটনীতির সাথেও যায় না।
সামগ্রিকভাবেই নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে তলে তলে আপোসের কোনো বিষয় আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ ধরনের কথায় সংশয় সৃষ্টি হয় এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করে।
আমাদের রাজনীতি এমনিতেই দৈন্যে ভরা। নেতাদের বোধ এবং কথা বলার ভঙ্গিমাও নিম্ন মানের। তার মধ্যে উচ্চস্তরের নেতাদের মুখ থেকে এমন বাক্য নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। মানুষ জানতে চায় রাজনীতির পক্ষে কি মন শক্ত করে সস্তা, হাস্যকর এবং বিপজ্জনক শব্দ বোমা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না?
কার সঙ্গে কীসের আপস করেছে আওয়ামী লীগ, তা খোলাসা করার দাবি জানিয়েছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বলয়। নির্বাচন ও আন্দোলন ঘিরে দেশে গুমোট পরিস্থিতিতে এই বক্তব্য নিয়ে অস্বস্তি আছে ক্ষমতাসীন শিবিরেও। তলে তলে কথাটি খুবই আপত্তিকর এবং রাজনীতিতে আপস কথাটি নেতিবাচক হিসেবেই পরিচিত। তলে তলে আপস করা হয়েছে বলার মাধ্যমে স্বচ্ছতার মাধ্যমে নয়, চুপিসারে কিছু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণায় দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ভিসা নীতিকে আঁকড়ে ধরে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করে সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের মনোবল বাড়িয়ে নির্বাচনমুখী করার জন্য নানা রকম বক্তব্য আসবে দলের নেতাদের কাছ থেকে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেমন হবে বাক্য ও শব্দ চয়ন, সেই ভাবনাটা গুরুত্বপূর্ণ।
একথা সত্য যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওপরে ওপরে অনেক দ্বন্দ্ব থাকলেও পর্দার অন্তরালে অনেক আলোচনাই হয়, সেগুলো প্রকাশ্যে আসেনা। আসলেও অনেক মার্জিত পরিভাষায় প্রকাশ করা হয়। তলে তলের মতো খুচরা কথা প্রকাশ্যে জনসভায় বলার মত শব্দ নয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, অপশব্দ শুধু মানুষকে নয়, এক সময় নিজেকেও আঘাত করে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।