ভয়াবহ আগুন সন্ত্রাসের শেষ কোথায়?
প্রকাশিতঃ 9:19 pm | November 06, 2023

কালের আলো রিপোর্ট :
বাস চালক সবুজ মিয়া রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে অছিম পরিবহনের যাত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন মেরাদিয়ায়। কিন্তু গন্তব্যে নামার আগ মুহূর্তে বাসটিতে আগুন দেয় বিএনপি-জামায়াত। এতে দগ্ধ হন সবুজ মিয়া। তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সবুজ মিয়ার শরীরের ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এছাড়া শ্বাসনালীও অনেকটা দগ্ধ হয়েছে। বর্তমানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। সোমবার (৬ নভেম্বর) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের হাই ডিফেনডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) সামনে দগ্ধ সবুজ মিয়ার স্ত্রী রুশেদা বেগম নিজের স্বামীর জন্য বিলাপ করছিলেন। তাঁর সাফ কথা, অভিযোগের তীর নষ্ট রাজনীতির দিকে। ক্ষোভ প্রকাশ করে রুশেদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী তো কোনো রাজনীতি করে না, সে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালায়। তাহলে আমার স্বামী আগুনে পুড়ল কেন?’
রুশেদা বেগমের এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তবে আগুন আগুন সন্ত্রাসের ভয়াবহ তাণ্ডব অব্যাহত রেখেছে মানুষ পুড়ানোর রাজনীতি করা দল দুটি। রোববার (৫ নভেম্বর) ভোর ৪টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই ৩৮ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারা দেশে ২১টি যানবাহনে আগুনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাঁরা। দিনভর বিএনপি-জামায়াতের তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান না হলেও আগুন সন্ত্রাসের জন্য তাঁরা রাতকেই বেছে নিয়েছে। এছাড়া ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১১০টি আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে দেশজুড়ে।
সোমবার (০৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেল জানিয়েছে, আগুনের ঘটনায় ঢাকা সিটিতে ১২টি, ঢাকা বিভাগে (গাজীপুর, কালিয়াকৈর, নারায়ণগঞ্জ) চারটি, চট্টগ্রাম বিভাগে (খাগড়াছড়ি, আনোয়ারা, পটিয়া) চারটি, রাজশাহী বিভাগে (বগুড়া) একটি ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৫টি বাস, দুটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার, একটি সিএনজি ও একটি লেগুনা পুড়েছে। এসব আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৪১টি ইউনিট ও ২৪২ জন সদস্য কাজ করেছেন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা দেখা গেছে, দিনের চেয়ে রাতে আগুন দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে। ৩৮ ঘণ্টায় ২১টির মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৬টি আগুনের ঘটনা ঘটে এবং বাকি পাঁচটি দিনের অন্য সময়ে ঘটে। এছাড়া ২৮ অক্টোবর ২৯টি, ২৯ অক্টোবর ১৯টি, ৩০ অক্টোবর একটি, ৩১ অক্টোবর ১১টি, ১ নভেম্বর ১৪টি, ২ নভেম্বর সাতটি, ৪ নভেম্বর ছয়টি, ৫ নভেম্বর ১৩টি ও ৬ নভেম্বর ১০টি আগুনের ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, দ্বিতীয় দিন সোমবার (৬ নভেম্বর) রাজধানীর গুলিস্তানে বিকল্প পরিবহনের বাসে আগুনের ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।’
এর আগে, অবরোধের প্রথমদিন শনিবার (৪ নভেম্বর) বিকেল থেকে গতকাল (৫ নভেম্বর) রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৯টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে কককেট নিক্ষেপ ও কিছু গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
রোববার (৫ নভেম্বর) ভোর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সাতটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া একটি পিকআপভ্যানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ভোরে ডেমরার মাতুয়াইলে সাদ্দাম মার্কেটের সামনে ও শ্যামপুরের জুরাইন বালুর মাঠ এলাকায় দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এরপর ভোর সোয়া ৫টায় মিরপুর-৬ নম্বরে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
৫ নভেম্বর সকালে মেরাদিয়ার বাঁশপট্টি এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। এতে ওই বাসের যাত্রী সবুজ মিয়া (৩০) দগ্ধ হন। সবুজ মিয়া পেশায় বাসচালক। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৈতালি নামে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। যদিও ওই আগুন তাৎক্ষণিকভাবে নেভানো সম্ভব হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে। ৫ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাংলামোটর মোড়ে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। বাংলামোটর পুলিশ বক্সের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এর আধাঘণ্টা পর মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর এলাকায় শিকড় পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ দুটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভায়।
৫ নভেম্বর রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর পলাশী মোড়ে একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই প্রাইভেটকারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে রাখা ছিল। এছাড়া একই সময়ে কারওয়ান বাজারে একটি পিকআপভ্যানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পিকআপের পেছনে থাকা সোফায় আগুন লাগে। পিকআপটি ওই সোফা ফেলে দিয়ে চলে যায়।
এছাড়া রোববার (৬ নভেম্বর) ভোরে চট্টগ্রামে পতেঙ্গার ধুমপাড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। সড়কের পাশে বাসটি রেখে চালক নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। হঠাৎ অটোরিকশায় চড়ে দুইজন লোক এসে বাসটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানা গেছে। আর সকাল ১০টার দিকে হবিগঞ্জ চুনারুঘাটে উপজেলা তাঁতী লীগের সভাপতি কবির মিয়া খন্দকারের প্রাইভেটকারে আগুন দেওয়া হয়। জানা গেছে, ওই প্রাইভেটকারে কয়েকজন যুবক পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় স্থানীয় লোকজন আগুন নেভান।
এদিন, খুলনার রূপসা উপজেলার তালিমপুর এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ফাঁকা বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রোববার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় বিএনপির অবরোধে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় পিকেটারদের ছোড়া ইটের আঘাতে সিএনজিচালকসহ যাত্রীরা আহত হয়েছেন। রোববার রাত ৮টার পর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এমসি বাজার এলাকার মাওনা সিএনজি পাম্পের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
একটি বাসে আগুন দেওয়ার জন্য কর্মীরা পান তিন হাজার টাকা
ঢাকায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম নির্দেশদাতা ছাত্রদল নেতা আমির হোসেন রকি ও তাঁর সহযোগী মো. সাকিব ওরফে আরোহানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত রোববার কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অভিযান চালায় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুই বোতল পেট্রোল ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। সিটিটিসি বলছে, বিএনপি নেতাদের নির্দেশে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের বিষয়টি সমন্বয় করে আসছিলেন রকি। একটি বাসে আগুন দেওয়ার জন্য কর্মীরা পান তিন হাজার টাকা।
আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ঘোষণা বিএনপি-জামায়াতের
একদিন বিরতি দিয়ে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ঘোষণা করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। অবরোধ ঘোষণা করেছে জামায়াতও। সোমবার (৬ নভেম্বর) বিকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে একদিন বিরতি দিয়ে আগামী বুধবার (৮ অক্টোবর) ভোর ৬টা থেকে শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ভোর ৬টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে।
নাশকতা ঠেকাতে কঠোর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা চলমান দ্বিতীয় দফার অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২২৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। সোমবার (৬ নভেম্বর) বিজিবি সদর দফতর থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। অন্যদিকে, র্যাব সারাদেশে ৪৬০টি টহল টিম মোতায়েন করেছে। এরমধ্যে ঢাকায় ১৬০টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াও রুখতে র্যাবের টহল টিম বাড়ানো হয়েছে। সড়কে যেন যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং যানবাহনকেন্দ্রিক নাশকতা কেউ যেন চালাতে না পারে সেজন্য এই টহল বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, নাশকতাকারী যেই হোক না কেন তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি যানবাহনের শ্রমিক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আরও বেশি সোচ্চার হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি বাড়াতে গত ৫ নভেম্বর আইজিপির নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও সকল গোয়েন্দা প্রধান এবং বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে মশিউর রহমান রাঙ্গা ও শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শাহজাহান খান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের এক পর্যায়ে মশিউর রহমান ও শাহজাহান খানের দাবির প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ সারাদেশে র্যাব ও বিজিবির টহল দল বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু র্যাব বা বিজিবি নয়, পুলিশেরও রিজার্ভ ফোর্স মাঠে নামানো হয়েছে। পুলিশ বলছে, অব্যাহত জ্বালাও-পোড়াও বন্ধে পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স মাঠে নেমেছে। সারাদেশের অন্তত অতিরিক্ত ২০ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
দূরপাল্লার বাসে নিরাপত্তা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে র্যাব
পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। ঢাকা থেকে খুলনা বা বগুড়াসহ দূরবর্তী গন্তব্যের পরিবহন মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। দূরপাল্লার ৮ থেকে ১০ টি বাস একত্রিত করে এসকর্ট দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। এতে করে চলাচলরত যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমবে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এই তথ্য জানিয়েছেন।
কালের আলো/আরআই/এএইচ