সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ‘স্বপ্নদর্শী’ প্রধানমন্ত্রীর শান্তির বার্তা
প্রকাশিতঃ 10:31 pm | November 21, 2023
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, সেনাকুঞ্জ ঘুরে এসে:
‘বিশ্বশান্তির অগ্রদূত’র খেতাব তাকে আগেই দিয়েছে বিশ্ব। নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, গতিশীল নেতৃত্ব, মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে শুধু দেশেই নন, বহির্বিশ্বেও অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। ‘মানবতার আলোকবর্তিকা’ সেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তির বার্তাই দিয়েছেন, দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশকে উল্লেখ করেছেন ‘শান্তির অন্বেষক’ হিসেবে। বলেছেন, ‘শান্তি শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয় আঞ্চলিক এবং সারা বিশ্বব্যাপী আমরা শান্তি চাই।’
কারও চোখ রাঙানোতে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো ‘রাষ্ট্রনায়ক’ তিনি নন মোটেও। তবুও ক্ষোভ নিয়েই বলেছেন, ‘কিছু লোক লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতা দখলের কথা ভাবছে, যা খুবই অমানবিক। যারা জনগণকে হত্যা করে লাশের ওপরে পাড়া দিয়ে ক্ষমতায় যাবার চিন্তা করে তাদের মতো অমানবিকতা আমি আর কোথাও দেখি না। এটা আমাদেরকে কাছে ভাবতেও অবাক লাগে। কাজেই আমরা শান্তি চাই।’
মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস- ২০২৩’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে বাস্তবিক উচ্চারণে অমিত দৃঢ়তায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি উপস্থাপন করেন সরকারপ্রধান। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান মঞ্চে তখন তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনও যুদ্ধ চান না। শান্তির পক্ষে থেকেই বন্ধুত্ব সুদুঢ় করতে চান সবার সঙ্গে। সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ চাই না আমরা শান্তিতে বাস করতে চাই। কিন্তু আমার দেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য যেন যথাযথ প্রস্তুতি আমাদের থাকে সেটাই আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা প্রস্তুত হিসেবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কাজ করবে,’ বলেন সরকারপ্রধান।
তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ উল্লেখ করে বলেন, ‘অন্তত আমি এটুকু দাবি করতে পারি এ পর্যন্ত আমরা আমাদের এই পররাষ্ট্র নীতি নিয়েই চলেছি। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে, আঞ্চলিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে আমাদের সমুদ্রসীমা, আমাদের স্থল সীমা, পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে আমাদের রিফিউজিদের ফিরিয়ে আনার মত ব্যবস্থা আমরা করেছি। সুচারুভাবে আমরা এগুলো করতে পেরেছি। এমনকি ছিটমহলগুলো আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিনিময় করতে পেরেছি। কাজেই বাংলাদেশ শান্তির দেশ।’
মমত্ববোধ, মহানুভবতা ও উদারনৈতিক মানসিকতার জন্য ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ অভিধায় ভূষিত চতুর্থবারের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা দিনবদলের পালায় নানামুখী কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষার প্রতীক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের প্রয়োজনেই আধুনিক, যুগোপযোগী ও সুসংগঠিত হিসেবে গড়ে তুলেছেন প্রতিনিয়ত। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ১৯৯৬ সালে তিনি সরকার এসেই সশস্ত্র বাহিনীতে নারী সদস্যদের অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টিও। আবার, সশস্ত্র বাহিনী দিবসে তিনি দিয়েছেন একটি সুসংবাদও। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও আমাদের দেশের নারী সদস্যরা অনেক সুনাম করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে এবং তিনি শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের আরো নারী সদস্যদের অন্তর্ভূক্তি প্রত্যাশা করেছেন। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর যে কর্ম ক্ষমতা সেটা আমরা বৃদ্ধি করতে পেরেছি। সমাজের কোন স্তরের মানুষই পেছনে পড়ে থাকবে না,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রবক্তা স্বপ্নদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরো বক্তব্যে ঠাঁই করে নেয় বিজয়ের পাঁচ দশক পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশকে ঈর্ষণীয় অগ্রগতির মাধ্যমে বদলে দেওয়া, দেশের জন্য বয়ে আনা গৌরব ও সাফল্য সবকিছুই। পুনর্ব্যক্ত করেন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। এ সময় তিনি বলেন, ‘২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবো। আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে উঠবে। অর্থাৎ স্মার্ট পপুলেশন, স্মার্ট গভমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা এভাবেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলবো এবং এগিয়ে নিয়ে যাব।’
যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করছে তাদের বোধোদয় হবে
একবিংশ শতকের অভিযাত্রায় বাঙালি জাতির কাণ্ডারি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগর শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতার আসন অলংকৃত করেছেন নিজের মেধায়-প্রজ্ঞায়, গণমানুষের ভালোবাসায় আর বিশ্বাসে। কিন্তু দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি গোষ্ঠীর পরিকল্পিত অগ্নিসন্ত্রাস ক্ষতবিক্ষত করে তাঁর হৃদয়কেও। তিনি বলেন, ‘মানুষ যখন একটু শান্তিতে ছিল, স্বস্তিতে ছিল, একটু আশার আলো দেখছিল এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এই অগ্নিসন্ত্রাস, হরতাল, অবরোধ মানুষের জীবনটাকে আবার ব্যাহত করছে। একটা শংকার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এটাই হচ্ছে সবথেকে কষ্টের বিষয়।
যারা এই ধ্বংসাত্মক কাজ করছে তাদের বোধোদয় হবে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁরা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ না করে গণতান্ত্রিক ধারায় যোগ দিক, জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখুক।’ বর্তমান সরকার একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ আমরা যেভাবে মোকাবেলা করলাম এরপরে অগ্নিসন্ত্রাস থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝামেলা মাঝে মাঝে শুরু হয়-সাধারণ মানুষকে কেন পুড়িয়ে মারা হয় সেটাই আমার প্রশ্ন? বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘এই সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা, বাসে আগুন দেওয়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করা এটা কি কারণে? আমার কাছে এটা এখনো বোধগম্য নয়।’
সব শ্রেণীর মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে সরকার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘হিজড়া, বেদে, কুষ্ঠ রোগীর থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে তাঁর সরকার। তাদের বিনামূল্যে ঘর করে দেওয়া হচ্ছে, জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে এবং আয় উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে সরকার।’ তাঁর সরকারের উন্নয়ন কেবল রাজধানী কেন্দ্রিক নয়, কেবল ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল বা কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়ন করা হচ্ছে। যাতে গ্রামে বসে প্রত্যেকটি গ্রামের মানুষ শহরের সব রকমের সুযোগ সুবিধা পেতে পারে, বলেন তিনি। টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান করা হচ্ছে ফলে সারা বিশ্বে আজকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
গর্বে তাঁর বুকটা ভরে ওঠে
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এজন্য গর্বে তাঁর বুকটা ভরে ওঠে। শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করতে গিয়ে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।’ তিনি বলেন, ‘এ দেশটা আমাদের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যেকোনো রকমের দুর্যোগ দেখা দিলে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সীমিত সম্পদের দেশ হলেও যেখানে দুর্যোগ হোক সে জায়গায় বাংলাদেশ ছুটে যায় এবং মানুষের পাশে দাঁড়ায় এবং আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে ভূমিকা রাখে।’
’৭৫-এর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশের ভাগ্যহত মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্যই তাঁর পথচলা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাবা মা ভাই সব হারিয়েছি, আমার আর হারাবার কিছু নেই। পাওয়ারও কিছু নেই। এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার বাবা যেহেতু সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তাই বাংলাদেশটাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনেও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী যথাযথ অবদান রেখে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এটা মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমাদের এই সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কাজেই সেই বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে চলতে চাই।’
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু হবে ২০২৬ সালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০২০ সালে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছি, সেই সময় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। যেটা ২০০৮ এর নির্বাচন ইশতেহার আমরা ঘোষণা করেছিলাম এবং সেই মোতাবেক কাজ করে আমরা এই লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরু হবে ২০২৬ সালে। ২০২৬ সালের এই যাত্রা যেন আমরা ভালোভাবে করতে পারি সেজন্য ইতিমধ্যে আমরা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। বাংলাদেশের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা যেন কেউ বন্ধ করতে না পারে। সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। তিনি বলেন, শান্তিতে সমরে সব জায়গায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদা সচেষ্ট এবং শক্তিশালী। সেই শক্তিশালী হিসেবেই একে আমরা গড়ে তুলছি।’
কালের আলো/এমএএএমকে